—ফাইল চিত্র।
যাদের করেছ অপমান,/ অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।” দুর্ভাগা এ দেশের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ যখন লিখেছিলেন এই কবিতা, ভারত স্বাধীন হয়নি, জনমতের ভিত্তিতে নির্বাচিত শাসক ও শাসনতন্ত্র আসেনি। আজ খাতায় কলমে এ সবই আছে, অষ্টাদশ সাধারণ নির্বাচনের তৃতীয় দফাও অতিক্রান্ত, কিন্তু একটি বিষয় পাল্টায়নি— শাসকের অপমান করার অভ্যাস। বৃহত্তম গণতন্ত্রের বৃহত্তম কলঙ্ক: মানুষের ভোটে নির্বাচিত শাসক অসম্মান করবে মানুষকেই, সেই অসম্মানকে নিয়ে যাবে নিয়মের পর্যায়ে। অসম্মানের স্তর বহুবিধ; তবে তার মৌলটি নিহিত জনপ্রতিনিধি হিসাবে দুর্বৃত্তের বাছাইয়ে। সাম্প্রতিক কালে ভারতের প্রতিটি নির্বাচনের তথ্য দেখিয়েছে, নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে অপরাধ কোনও ধর্তব্য বিষয়ই নয়। বিশেষত কেন্দ্রে শাসক দলটির কাছে প্রার্থীর অপরাধের খতিয়ান প্রায় শংসাপত্রের মতো: অপরাধের ধার-ভার যত, গুরুত্বও তত। তা না হলে কেনই বা প্রজ্বল রেভান্না, ব্রিজভূষণ সিংহ, কুলদীপ সেঙ্গাররা নির্বাচনে বিজেপির মুখ হয়ে উঠবেন, কারও সমর্থনে জনসভায় ভোট চাইবেন খোদ প্রধানমন্ত্রী; বিলকিস বানো গণধর্ষণে অভিযুক্তদের ‘সংস্কারী’ বলে বরণ করা নেতা টিকিট পেয়ে যাবেন বিধানসভা ভোটে!
এক জন নির্বাচিত সাংসদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও নারী-নির্যাতনের ভিডিয়ো, ছবি ও তথ্য-সম্বলিত তিন হাজার ফাইলের পেন ড্রাইভ পাওয়া যাচ্ছে, উঠে আসছে একের পর এক অভিযোগ, ভোট শেষ হতেই বিদেশে পালানো নেতার বিরুদ্ধে জারি হচ্ছে ইন্টারপোলের নোটিস। কোনও নেতার বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ তুলে আন্দোলনে নামছেন দেশের সেরা কুস্তিবিদরা, প্রতিবাদে খেলাই ছেড়ে দিচ্ছেন কেউ। এই নেতাদের দুষ্কৃতির বহর দেখলে শিউরে উঠতে হয়, কিন্তু আরও আতঙ্ক জাগে ন্যূনতম বা বিনা শাস্তিতে তাঁদের পার পেয়ে যাওয়ার উদাহরণে। কারও ক্ষেত্রে তা দল থেকে বহিষ্কার, সময়-সুযোগ বুঝে পরে দলে বা জোটে ফিরিয়ে নেওয়া; কারও ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে টিকিট না দিয়ে তার ছেলেকে প্রার্থী করা— আম ও ছালা দুই-ই রইল। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর কলঙ্কও বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘ জটিল আবর্তে পড়ে ক্রমে মুছে যায় জনস্মৃতি থেকে। এ এক অমোঘ চক্র, যেখানে অভিযুক্ত, অপরাধী বা কলঙ্কিত নেতার মুখগুলি পাল্টে পাল্টে যায়, পাল্টায় না দলের এবং ক্ষমতার ছত্রছায়ায় এদের লালন-পালন ও রক্ষণের বন্দোবস্তটি। বিজেপির শাসনে এমন দৃষ্টান্তের বাড়বাড়ন্তই বুঝিয়ে দেয়, এক জন নেতা, প্রার্থী বা জনপ্রতিনিধির জন্য কোনটা গ্রহণযোগ্য আচরণ আর কোনটা নয়, অভিযুক্ত বা অপরাধী প্রার্থী কোন সীমা ছাড়ালে তাঁকে পরিহার করা দরকার— এ নিয়ে তাদের কোনও নীতি নেই; আছে শুধু যাবতীয় নৈতিকতার জলাঞ্জলি, সীমাহীন পক্ষপাত।
শাসক দলের এমন আচরণ শুধু গণতন্ত্রের পরিপন্থীই নয়, তা দাঁড়িয়েই আছে নাগরিকের মতকে সীমাহীন ঔদ্ধত্যে অবজ্ঞা ও উপেক্ষার উপরে। অপরাধ ও অপরাধীর প্রশ্রয় যদি এর একটি দিক, অন্য দিকটি তবে নাগরিক গোষ্ঠীর নানা স্তরের অধিকার ও ক্ষমতায়নকে সর্বৈব অস্বীকার; কখনও নারী, কখনও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, কখনও বা দলিতের নিপীড়ন। বিজেপি ও তার জোট নির্বাচনী ইস্তাহার ও জনসভায় নারীর ক্ষমতায়নের কথা বললেও, তাদের অগণিত নেতা-কর্মী ও প্রার্থীর কীর্তিকলাপেই পরিষ্কার, মেয়েদের সম্মান, সাম্য, নিরাপত্তার প্রশ্ন তাঁদের কাছে অবান্তর ও নিরর্থক, মহিলারা তাঁদের কাছে ভোটব্যাঙ্ক বই আর কিছু নয়। ধর্মীয় মেরুকরণ ও জাতপাতের রাজনীতি নিয়ে তো কথাই নেই, দু’টিই হয়ে উঠেছে শাসক দলের প্রার্থীদের ভোট দখলের অস্ত্র। গণতন্ত্রের মূল সুরটিই নাগরিকের অধিকার ও সম্মান, তাকে ক্রমাগত অস্বীকার করে বেশি দূর এগোনো যায় না, শাসকের মনে রাখা প্রয়োজন।