অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন হতাশ করেননি। ফাইল ছবি।
নির্বাচনমুখী বাজেট হবে, কথা ছিলই। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন হতাশ করেননি। আয়কর ছাড়ের হিসাব কষতে মধ্যবিত্ত ব্যস্ত হবে; অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলি দেখবে জরিমানা মকুব, ঋণ এবং করের সুবিধাবাবদ মোট কত লাভ হল। তফসিলি জাতি, জনজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত মানুষ বুঝে নিতে চাইবেন, অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেটবক্তৃতায় তাঁদের কথা যতখানি বললেন, প্রকৃত সুবিধার পরিমাণ ততখানিই কি না। ঘটনা হল, নির্বাচনমুখী বাজেট মানেই যে তা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন-লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। এমএসএমই-র ক্ষেত্রে যেমন এক দিকে বিপুল কর্মসংস্থান ঘটে, ফলে তা নির্বাচনী পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই এই ক্ষেত্রটির প্রকৃত উন্নয়ন হলে তা ভারতীয় অর্থব্যবস্থার পক্ষেও বিবিধার্থে মঙ্গলজনক। রাজস্ব আদায়ের মোট পরিমাণ অক্ষুণ্ণ রেখে যদি বিশেষত তুলনায় স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর উপরে আয়করের বোঝা কমানো যায়, তবে তা ভোগব্যয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে অর্থব্যবস্থার পক্ষে সুখবর হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এই বাজেট অনেকগুলি প্রশ্ন রেখে গেল। আগামী অর্থবর্ষে যে হারে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটবে ধরে নিয়ে বরাদ্দ স্থির করা হয়েছে, প্রকৃত বৃদ্ধির পরিমাণ ততখানি হবে কি? যদি না হয়, তবে খরচের টাকা আসবে কোথা থেকে? এই মুহূর্তের বৃহত্তম সমস্যা হল কর্মসংস্থানহীনতা— এই বাজেটে তার কোনও প্রত্যক্ষ সমাধান-প্রচেষ্টা না থাকা কিসের ইঙ্গিতবাহী? লক্ষণীয় যে, গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনার খাতে বরাদ্দ বিপুল পরিমাণে কমেছে— তা হলে কি সরকার আশাবাদী যে, কোনও প্রত্যক্ষ প্রচেষ্টা ব্যতীতই বাজারে কর্মসংস্থান বাড়বে?
অনুমান করা চলে যে, মূলধনি খাতে বরাদ্দবৃদ্ধির মাধ্যমে কাজ সৃষ্টি এবং কর্মসংস্থানের কথা ভেবেছেন অর্থমন্ত্রী। এই বাজেটে মূলধনি খাতে যে ব্যয়বরাদ্দ হল, তা অ-পূর্ব। দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের লক্ষ্যে মূলধনি খাতে ব্যয়ের কোনও বিকল্প নেই। তবে, কয়েকটি প্রশ্ন থেকে যায়। যেমন, গত বাজেটে মূলধনি খাতে যে বরাদ্দ হয়েছিল, বাজেটের সংশোধিত হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে, ব্যয়ের পরিমাণ ছিল তার চেয়ে কম। এ বছর যদি বৈশ্বিক কারণে আয়বৃদ্ধির হার আশানুরূপ না হয়, এবং তার ফলে যদি এই ক্ষেত্রে প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ বাজেট বরাদ্দের চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে কম হয়, কর্মসংস্থানের উপর তার কী প্রভাব পড়বে? দ্বিতীয়ত, অর্থমন্ত্রী আশাপ্রকাশ করেছেন, মূলধনি খাতে সরকারের এই ব্যয়বৃদ্ধির ফলে বেসরকারি লগ্নির ‘ক্রাউডিং ইন’ হবে, অর্থাৎ লগ্নিকারীরাও বিনিয়োগ করবেন। অর্থশাস্ত্রের পাঠ্যবই এই প্রশ্নে যা বলে, সে কথা যদি ঊহ্যও থাকে, এ কথা ভুললে চলবে না যে, বিগত কয়েক বছরে লগ্নিকারীরা যাবতীয় সুবিধা সত্ত্বেও হাত উপুড় করেননি। এ বার করবেন, সে ভরসা কোথায়? এবং এই প্রসঙ্গেই কর্পোরেট করের হার অপরিবর্তিত রাখার কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন। তাতে গত সাড়ে তিন বছরে অর্থব্যবস্থার কোনও প্রকৃত লাভ হয়েছে কি না, সেই হিসাব দেওয়ার দায়ও অর্থমন্ত্রীর উপরেই বর্তায়।
বাজেট বক্তৃতায় বারে বারেই এসেছে তরুণ প্রজন্মের কথা— ২০৪৭ সালের লক্ষ্যে সেই প্রজন্মের ভূমিকার কথা। ভারতের ‘ডেমোগ্র্যাফিক ডিভিডেন্ড’ বা তারুণ্যের সুযোগ নিয়ে বহু কথা ইতিপূর্বেও হয়েছে। কিন্তু, সেই লাভ অর্জনের জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল— শুধুমাত্র বৃত্তিমুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সে কাজ হওয়ার নয়। এই বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে অর্থবরাদ্দ যেটুকু বেড়েছে, তা বড় জোর মূল্যস্ফীতির ধাক্কাটুকু সামলাতে পারে। অর্থব্যবস্থাকে যদি সত্যই প্রকৃত উন্নয়নের অভিমুখে পরিচালনা করতে হয়, তবে বরাদ্দের অভাব কথায় ঢাকার অভ্যাসটি ত্যাগ করা জরুরি।