বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ দু’জনেই একে তমোগুণান্বিত অক্রিয়তা, ক্লীবতা বলে চিহ্নিত করেছিলেন। ফাইল ছবি।
আদি ভারত সময়ের কল্পনায় চক্রগতিকে স্বীকার করত। এই চক্রগতি জীবনদর্শনেও প্রবেশ করেছিল। ভারতীয়রা মনে করতেন সুখের পর দুঃখ আসে, দুঃখের পরে সুখ। এই চক্রবৎ পরিবর্তনের নিয়তি মেনে নিলে মানুষকে এক রকম আলস্য গ্রাস করে। ভারতীয়রা অলস গৃহসুখপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন। নিয়তি-নির্ধারিত জীবনে বিশ্বাসী, অপ্রয়াসী আলস্যগ্রস্ত সেই সমাজমনকে পরবর্তী চিন্তকেরা সমালোচনা করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ দু’জনেই একে তমোগুণান্বিত অক্রিয়তা, ক্লীবতা বলে চিহ্নিত করেছিলেন। এই চক্রাকারগতি-নির্ধারিত নিয়তিতে বিশ্বাস শুধু আলস্যকেই জল-বাতাস দেয় না, প্রবঞ্চনার পথও প্রস্তুত করে। বর্ণাশ্রম লাঞ্ছিত জাতিভেদতাড়িত ভারতে উচ্চবর্ণীয়রা তাঁদের কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখার জন্য কর্মফলবাদের চক্রগতিতে সকলকে বিশ্বাসী করে তুলেছিলেন। এ যেন প্রবঞ্চনার সম্মতি প্রবঞ্চিতদের কাছ থেকেই আদায় করা। শূদ্ররা কেন প্রবঞ্চনা মেনে নেবেন? কেন তাঁরা অধিকারবিহীন কায়িক শ্রমের নিঃশর্ত কারাগারে বন্দি থাকবেন? চক্রবৎ চালিত নিয়তিই নাকি এর কারণ। পূর্বজন্মের পাপে এ জন্মে তাঁদের ফলভোগ করতে হচ্ছে। আগামী জন্মে ভাল থাকার জন্য তাঁদের তাই নিঃশর্তে উচ্চবর্ণের সেবা করতে হবে। মুখবন্ধ-সেবাকর্ম পুণ্যকর্ম। যদি পুণ্যকর্মের ফলে আগামী জন্মে রেহাই মেলে! সহজেই বোঝা যায়, অনীতিবিধায়ক প্রবঞ্চনার চাকা ঘোরানোর জন্য ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতিবাদীরা, মনুপন্থীরা এই কর্মফলের অলীক চাকা বনবন করে ঘোরাতেন।
সেই চক্রবৎ নিয়তির ধারণা কত রকম ভাবে যে থেকে যায়! পশ্চিমবঙ্গে এখন যখনই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেউ সরব হচ্ছেন, তখনই বর্তমান শাসক দলের নেতা-কর্মীরা পূর্ববর্তী জমানার উদাহরণ দিচ্ছেন। ভাবখানা এই, দুর্নীতির চাকা ঘুরছে। আগেও ছিল, এখনও আছে। আমাদের একা দোষ দেওয়া কেন! এই যুক্তি ওই চক্রাকার যুক্তিতন্ত্রের কাঠামোর অনুসারী। দুর্নীতির চাকা চক্রবৎ ঘুরছে। এ কথা যাঁরা বলছেন, তাঁরা জনমানসের ভাবগতিক বিলক্ষণ জানেন। জনগণ কী মন্ত্রে ভোলেন আর কী মন্ত্রে ভোলেন না সে বিষয়ে তাঁদের সুনির্দিষ্ট ধারণা আছে, সে জন্যই এই আগের দুর্নীতির কথা বলা। মুখ নিচু করে চলা নিয়তি-নির্ধারিত সমাজমন কপালের দোহাই দিয়ে বলবে, আগেও ছিল, এখনও আছে। এ আর নতুন কী? আগের দুর্নীতি বেশি না এখনকার, এ নিয়ে সান্ধ্য আড্ডা ও তর্ক জমবে। জনমনে বিক্ষোভ সঞ্চারিত হবে না। রবীন্দ্রনাথের ‘কর্তার ভূত’ রচনায় কর্তার মৃত্যুর পর দেশবাসী বেজায় ভীত। এখন তাদের হয়ে কে চিন্তা করবে? কে স্থিতাবস্থা বজায় রাখবে? তখন কর্তা ভূত হয়ে থেকে গেলেন। ভূত অর্থে অতীত। বঙ্গবাসীর ঘাড়ে দুর্নীতির ভূত বজায় রইল। আর তা সাধারণ বঙ্গবাসীর নিয়তিবাদী মনোভঙ্গির জন্যই যেন বজায় রইল।
যুক্তিবাদী মন চক্রাকার যুক্তির নিশ্চিন্ততা থেকে বাইরে আসতে চাইবে। আগের দুর্নীতি পরের দুর্নীতিকে স্বাভাবিক বা অনিবার্য বলে প্রতিষ্ঠা করে না। আগের দুর্নীতিও অপরাধ, এখনকার দুর্নীতিও অপরাধ। দলদাসদের ‘তুই চোর’ ‘তুইও চোর’ জাতীয় তর্কাতর্কি সন্ধেবেলার টিভির পর্দায় উত্তেজনার উপভোগ্য দৃশ্যকাব্য হতে পারে, কিন্তু তা দিয়ে রাজ্য ও দেশ চলে না। সুতরাং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের বলার সময় এসেছে, দুর্নীতির শাস্তি চাই। অতীত ধুয়ে জল খাওয়ার মানে হয় না। রূপকথার গল্পে ভেড়াটিকে সংহার করার আগে চালাক সিংহ বলেছিল, জল ঘোলা করাই তার মৃত্যুর কারণ। ভেড়া জিজ্ঞাসা করেছিল, সে তো জল ঘোলা করেনি, তবে কেন সে দোষের বাহক হবে! উত্তরে সিংহ জানাতে ভোলেনি, সে জল ঘোলা না করলেও তার বাবা জল ঘোলা করেছে। সুতরাং সিংহের হাতে তাকে মরতে হবে। পশ্চিমবঙ্গবাসী প্রায় একই রকম অপযুক্তি শুনছেন। দুর্নীতি তাঁদের গিলে খাচ্ছে। নাগরিক অধিকার খর্ব করছে। প্রশ্ন করলে শুনতে হচ্ছে, তাঁদের আগের প্রজন্ম আগের জমানায় দুর্নীতিবধ্য ছিল, এ জমানাতেও তাই দুর্নীতিবধ্য হওয়াই তাঁদের নিয়তি। নাগরিক সমাজের পাল্টা প্রশ্নের ঢেউ এই চক্রাকার যুক্তিকে ভেদ করতে পারে। সময়ের চক্রাকার গতির বাইরে সময়ের সরলরৈখিক গতির ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ। এই গতিধারা বলে, অতীতকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সংশোধন করে। সংসদীয় গণতন্ত্রে চক্রগতির দোহাই তোলা অনুচিত। আগের দুর্নীতি বর্তমানকে দুর্নীতিপরায়ণ হতে বলে না, দুর্নীতি যাতে আগের মতো না হয় সেই সংশোধিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে বলে।