অনিয়মের অভিযোগে ত্রিশ হাজারের বেশি প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছিলেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। ফাইল ছবি।
অনিয়মের অভিযোগে ত্রিশ হাজারের বেশি প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিল করার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, তার উপর অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ জারি করতে গিয়ে ডিভিশন বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ: বিচারে বিলম্ব হলে যেমন বিচার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনই তড়িঘড়ি বিচারেও বিচারপ্রক্রিয়ার ক্ষতি হয়। মন্তব্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিলম্বিত বিচার অবিচারের শামিল, কিন্তু সুবিচারের জন্য প্রয়োজনীয় সময় এবং বিবেচনাও কম জরুরি নয়। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অসঙ্গতি, অনিয়ম বা দুর্নীতির প্রকোপ যে কতটা গুরুতর, তা ইতিমধ্যে সর্বজনবিদিত। এই বিষয়ে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো বিচারকদের ভূমিকাও নিঃসন্দেহে নাগরিকের শ্রদ্ধার্হ এবং অভিবাদনযোগ্য। কিন্তু অনিয়মের অভিযোগে চিহ্নিত শিক্ষকদের নিয়োগের প্রক্রিয়াটিকে সংশোধন করার জন্য তো তিনি আগামী তিন মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ তথা যাচাইয়ের নির্দেশ দিয়েছেন, যে যাচাইয়ের পরে তাঁদের চাকরির ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে। ডিভিশন বেঞ্চও এই বিষয়ে সহমত। সাধারণ বুদ্ধিতে, এবং মাননীয় বিচারপতির প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা সহকারেই, প্রশ্ন তোলা যায়— এই কয়েক মাস অপেক্ষা না করে এখনই শিক্ষকদের চাকরি বাতিল করা এবং পার্শ্বশিক্ষকের বেতনে কাজ করতেবলার নির্দেশটির যৌক্তিকতা কী ছিল, প্রয়োজনই বা কতটা? অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী প্রমাণিত না হওয়া অবধি নির্দোষ বলে গণ্য হবেন— ভারতীয় বিচার-দর্শনের এই মৌলিক আদর্শটিও কি একই প্রশ্ন তোলে না?
মনে রাখতে হবে, এমন বিপুল সংখ্যায় চাকরি বাতিল এবং বেতন ছাঁটাইয়ের সম্মুখীন হলে শিক্ষকদের উপর প্রবল মানসিক চাপ পড়ার আশঙ্কা থাকে, আশঙ্কা থাকে তাঁদের সামাজিক মর্যাদাহানির, এবং সর্বোপরি আশঙ্কা থাকে স্কুলের পঠনপাঠনে বড় রকমের ব্যাঘাত সৃষ্টির। বস্তুত, ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের পরেও সামগ্রিক অনিশ্চয়তা এবং অবিশ্বাসের পরিবেশ কতটা কাটবে, বলা শক্ত। অন্য নানা পরিসরের তুলনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, বিশেষত স্কুলের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য আছে: ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকশিক্ষিকাদের (এবং অভিভাবক তথা বৃহত্তর সমাজের) পারস্পরিক আস্থা ও সুসম্পর্ক সুষ্ঠু পঠনপাঠনের জন্য অত্যাবশ্যক। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই সেই সম্পর্কের বিস্তর ক্ষতি হয়েছে। বর্তমান জমানায় আদিগন্ত দুর্নীতির সাম্রাজ্য এবং, তার পাশাপাশি, শিক্ষার প্রতি সরকারি নায়কনায়িকাদের চূড়ান্ত ঔদাসীন্য গোটা পরিস্থিতিকে এক অকল্পনীয় সঙ্কটের অতলে নিক্ষেপ করেছে। এই ভয়াবহ অবস্থার প্রতিকারে সমস্ত স্তরে অবিলম্বে সর্বশক্তি নিয়োগ করা জরুরি, তা না হলে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সামনে শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
এখানেই শিক্ষাব্যবস্থার পরিচালকবর্গ এবং রাজ্য সরকার তথা শাসক দলের নেতানেত্রীদের অপরিসীম দায়িত্ব, যে দায়িত্বের কণামাত্রও তাঁরা পালন করেননি। এক দিকে প্রতিবাদীদের লাগাতার বিক্ষোভ আন্দোলন এবং অন্য দিকে বিচারবিভাগের তৎপরতা, এই দুইয়ের কল্যাণে শিক্ষা-প্রশাসনের যে ছবি উন্মোচিত হয়েছে, তা রাজ্যের শাসকদের পক্ষে অকল্পনীয় লজ্জা এবং কলঙ্কের। মনে রাখা দরকার, ডিভিশন বেঞ্চের রায়েও অনিয়মের আশঙ্কাকে স্পষ্ট স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হল, এই সার্বিক অনাচারের ইতিহাসকে পিছনে ফেলে শাসকরা ঘুরে দাঁড়াতে চাইবেন কি না। যদি চান, তবে প্রথম কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন করা। তার সঙ্গে সঙ্গে সামগ্রিক ভাবে শিক্ষক নিয়োগ এবং স্কুলশিক্ষার আয়োজনে যত রকমের ঘাটতি আছে, সেগুলি পূরণ করতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ঝাঁপিয়ে পড়া। আক্ষরিক অর্থেই, কারণ সর্বনাশের সঙ্গে যুদ্ধ না করে তাকে আটকানো আজ আর সম্ভব নয়।