সরকারি স্কুলে পড়াশোনার খরচ বেসরকারি স্কুলের তুলনায় অনেক কম। প্রতীকী ছবি।
পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন স্তরে স্কুলশিক্ষক নিয়োগে অন্তহীন দুর্নীতির অভিযোগ ও তার নিত্যনতুন সাক্ষ্যপ্রমাণ উদ্ঘাটনের অবিরত বিভীষিকার ফাঁকে সম্প্রতি অন্য এক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে নিহিত আছে চূড়ান্ত সর্বনাশের আশঙ্কা, যে আশঙ্কা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হলে সরকারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে আর কোনও গোলযোগের অবকাশই থাকবে না, কারণ সরকারি স্কুলেরই আর কোনও প্রয়োজন থাকবে না। সংবাদটি এই যে, রাজ্যের নানা এলাকায় বিভিন্ন সরকারি স্কুলে আসনসংখ্যার তুলনায় ছাত্রছাত্রী ভর্তির হার কম। তার ফলে, লটারির মাধ্যমে এই সব স্কুলে ভর্তির সুযোগ দেওয়ার যে ব্যবস্থা অনেক দিন যাবৎ প্রচলিত, অনেক স্কুলেই সেটি ক্রমে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে, লটারির আর প্রয়োজনই হচ্ছে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি এই পরিস্থিতির একটি কারণ হতে পারে বটে, কিন্তু অধিকাংশ স্থানেই সেটি আসলে গৌণ কারণ। মুখ্য কারণ এই যে, অভিভাবকরা সন্তানদের বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করাতে চাইছেন, সরকারি স্কুলে নয়। অর্থাৎ, এক কথায়, সরকারি স্কুলের চাহিদা কমছে। কলকাতা তথা শহরাঞ্চলে এই সমস্যা স্বভাবতই বেশি, কারণ সেখানে বেসরকারি স্কুলের জোগান তুলনায় বেশি। কিন্তু গ্রামীণ এলাকাও এই প্রবণতা থেকে একেবারেই মুক্ত নয়। ইতিমধ্যেই সরকারি অর্থে চলা অনেক স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা তলানিতে ঠেকেছে। এই প্রবণতা আরও প্রসারিত হলে সমস্যা আক্ষরিক অর্থেই সর্ব-নাশে পরিণত হবে।
কেন এই পরিস্থিতি? সরকারি স্কুলে পড়াশোনার খরচ বেসরকারি স্কুলের তুলনায় অনেক কম। তদুপরি ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পায়। অন্য দিকে, বেসরকারি স্কুলগুলি কেবল ব্যয়সাপেক্ষ নয়, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের লেখাপড়ার মান নিয়েও রীতিমতো প্রশ্ন আছে। তা সত্ত্বেও অভিভাবকরা সরকারি স্কুলের প্রতি উত্তরোত্তর বিমুখ কেন? উত্তর একটাই: সেখানে পড়াশোনা হয় না। তার প্রথম এবং প্রধান কারণ, বহু স্কুলেই শিক্ষকের ঘাটতি। দীর্ঘ দিন ধরে এই ঘাটতি চলে আসছে, কিন্তু সাম্প্রতিক কালে তার মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়েছে। এক দিকে অব্যবস্থা ও দুর্নীতির কারণে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় বড় রকমের ব্যাঘাত ঘটেছে, অন্য দিকে সরকারের হঠকারী এবং অপরিণামদর্শী নীতির ফলে গ্রামাঞ্চলের, বিশেষত শহর থেকে দূরবর্তী এলাকার বহু স্কুল থেকে শিক্ষকরা অন্যত্র বদলি নিয়ে চলে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনেক শিক্ষকের অমনোযোগ, ঔদাসীন্য এবং নির্ভেজাল ফাঁকিবাজি, যার ফলে দিনের পর দিন স্কুলে পঠনপাঠনের কাজ কিছুমাত্র হয় না। অভিভাবকরা নিরুপায় হয়েই বেসরকারি স্কুলের দিকে পা বাড়াচ্ছেন, আর্থিক সমস্যা স্বীকার করেও।
পশ্চিমবঙ্গে আরও কিছু দিন এই প্রক্রিয়া চলতে পারে, কারণ অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় এই রাজ্যে এখনও স্কুলের শিক্ষার্থীরা অনেকটা বেশি অনুপাতেই সরকারি স্কুলে পড়তে যায়, অর্থাৎ বেসরকারি স্কুলের আধিপত্য তুলনায় এখনও কম। কিন্তু সেটাই আরও বেশি পরিতাপের বিষয়। সরকারি উদ্যোগে সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার একটি বিস্তীর্ণ বন্দোবস্ত আছে, স্কুলের পরিকাঠামোও অতীতের তুলনায় অনেকটা উন্নত হয়েছে, অথচ যে লেখাপড়ার জন্য স্কুল, সেখানেই বিরাট ঘাটতি তৈরি হয়েছে এবং সেই ঘাটতি বেড়েই চলেছে। এই লজ্জাকর এবং কলঙ্কজনক ব্যর্থতার ষোলো আনা না হোক পনেরো আনা দায় রাজ্য সরকারের উপরেই বর্তায়। শিক্ষাব্যবস্থা যাঁরা চালান তাঁরা সম্ভবত এই ব্যবস্থার প্রাথমিক উদ্দেশ্যটিই সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছেন, তা না হলে আজ এই পরিণতি হতে পারত কি? কে জানে, এমনটাই হয়তো তাঁদের পছন্দ— অন্তর্জলি যাত্রার তো কোনও পরিশ্রম নেই।