এম কে স্ট্যালিনের পুত্র তথা রাজ্যের মন্ত্রী উদয়নিধি। ছবি: পিটিআই।
তামিলনাড়ুর যুবকল্যাণ ও ক্রীড়া দফতরের মন্ত্রী উদয়নিধি স্ট্যালিনের বয়স পঁয়তাল্লিশ অতিক্রান্ত। ভারতীয় রাজনীতির মাপকাঠিতে তাঁকে নবীন বলা গেলেও, সেই নবীনতা কিন্তু কখনওই অপরিণত কথা বা কাজের ছাড়পত্র দেয় না। কেবল বয়সের বিচারে নয়, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাতেও তাঁর আচরণে বিবেচনাবোধের পরিচয়ই প্রত্যাশিত। সনাতন ধর্ম সম্পর্কে তাঁর সমালোচনা থাকতেই পারে, তার বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান গ্রহণের অধিকারও অবশ্যই তাঁর আছে, যেমন আছে যে কোনও নাগরিকের। কিন্তু সেই সমালোচনার ভাষা এবং ভঙ্গি যে স্বাভাবিক সংযমের মাত্রা অতিক্রম করতে পারে না, এই কাণ্ডজ্ঞান এক জন গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক তথা মন্ত্রীর থাকা উচিত। মত প্রকাশের স্বাধীনতা অত্যন্ত মূল্যবান, আজকের ভারতে তার মূল্য দ্বিগুণ, কিন্তু স্বাধীনতা আর যথেচ্ছাচার এক নয়। বিশেষত, রাজনীতির জনপরিসরে যাঁদের বিচরণ, তাঁদের আপন মতামত জানানোর ক্ষেত্রে তার পরিণাম ভেবে চলা অত্যন্ত জরুরি। উদয়নিধি সেই দায়িত্ব পালন করেননি। দৃশ্যত, করতে চাননি।
ভারতীয় রাজনীতির বর্তমান বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এই কটুভাষণ আরও বেশি সমস্যাজনক। উদয়নিধি কেবল তামিলনাড়ুর শাসক দল ডিএমকে-র নেতা ও রাজ্যের মন্ত্রী নন, মুখ্যমন্ত্রীর পুত্রও বটে। এই ব্যক্তিগত পরিচয়ের কারণে তাঁর উক্তির দায় মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনের উপরে এসে পড়তে বাধ্য— বাস্তব কেন বাধ্যতে। আগামী লোকসভা নির্বাচনের উদ্যোগপর্বে বিজেপি-বিরোধী মঞ্চ নির্মাণের প্রক্রিয়া ক্রমশ জোরদার হচ্ছে, সেই ‘ইন্ডিয়া’ নামক মঞ্চটিতে ডিএমকে তথা তার মুখ্য নেতা স্ট্যালিনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। উদয়নিধির ভাষণে এবং পরবর্তী আত্মপক্ষ সমর্থনের সওয়ালে ‘সনাতন ধর্মের আদর্শকে মুছে ফেলা’র নির্ঘোষ এই মঞ্চের শরিক দলগুলিকে বিপাকে ফেলতে বাধ্য। ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় বহু মানুষ এই সওয়ালের ভাষায় আহত হবেন, করোনা, ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গির সঙ্গে সনাতন ধর্মের তুলনা শুনে প্রীত হবেন না— এই বাস্তব নিশ্চয়ই তাঁর অজানা নয়। তিনি হয়তো আপন রাজ্যের তথা দক্ষিণ ভারতের সামাজিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিত বা রাজনৈতিক স্বার্থের কথা মাথায় রেখে এই যুদ্ধঘোষণার পথ নিয়েছেন, কিন্তু সর্বভারতীয় রাজনীতির পক্ষে এই পথ কেবল বিপজ্জনক নয়, আত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারে। ক্ষুদ্রতর আঞ্চলিক স্বার্থের তাড়নায় বৃহত্তর সমন্বয়ের সম্ভাবনাকে বিসর্জন দেওয়ার নাম যথার্থ রাজনীতি নয়।
বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার যে এমন একটি সুবর্ণসুযোগের সদ্ব্যবহার করতে প্রবল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়বে, সে বিষয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশ ছিল না। শাসকগোষ্ঠী যথারীতি ষোলো আনায় সন্তুষ্ট না থেকে রাজনীতির সমুদ্র মন্থন করে আঠারো আনা গরল উদ্ধারে তৎপর— গোষ্ঠীপতিরা কেবল সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধ আক্রমণের নিন্দায় সীমিত থাকেননি, উদয়নিধিকে গণহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। এই প্রচারের উত্তরে তামিল নেতা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি সনাতন ধর্মের অবসান চাইছেন, তার সঙ্গে সেই ধর্মের অনুসারী বা ধ্বজাধারীদের প্রতি হিংস্রতার কোনও প্রশ্ন নেই, ঠিক যেমন নরেন্দ্র মোদীর কংগ্রেস-মুক্ত ভারত গড়ার ডাকটিতে কংগ্রেসিদের আক্রমণের কোনও প্ররোচনা থাকে না। এই সহজ স্বাভাবিক সত্যটি অভিযোগকারীদের না জানার কোনও কারণ নেই। কিন্তু রাজনীতির জল ঘোলা করতে সত্যের মূল্য যৎকিঞ্চিৎ, সস্তা আবেগের দাম বহুগুণ বেশি। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকরা সত্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে তামিল রাজনীতিকের অবিবেচনার সুযোগ নেওয়ার বদলে তাঁর বক্তব্যে ‘সনাতন ধর্ম’ নামক ধারণাটির যে গভীর সমালোচনা নিহিত আছে তার সদুত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু সৎ উত্তর খুঁজতে চাইলে সৎসাহসের প্রয়োজন হয়। সে অতি দুর্লভ বস্তু।