বিলকিস বানো। —ফাইল চিত্র।
বিলকিস বানোর ধর্ষকদের সাজা মকুবের সিদ্ধান্তটি শীর্ষ আদালতে নাকচ হয়ে গেল, এই সংবাদটি ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে স্বস্তির। সাধারণ মানুষ ভরসা পাবেন যে, তাঁদের রক্ষা করার জন্য অন্তত শীর্ষ আদালত রয়েছে। কিন্তু, কিসের থেকে রক্ষা পেতে হবে নাগরিককে? ধর্ষকদের থেকে? দাঙ্গাবাজ, খুনিদের থেকে? সুপ্রিম কোর্টকে তার রায়ে যে কথাগুলি বলতে হল, তাতে স্পষ্ট যে, এই পরিচিত অপরাধীদের থেকে নাগরিকের যতখানি রক্ষা করা প্রয়োজন, সম্ভবত তার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন পক্ষপাতদুষ্ট রাষ্ট্রযন্ত্রের হাত থেকে নাগরিকদের বাঁচানো, গণতন্ত্রের আব্রু রক্ষা করা। আদালতের বক্তব্যের ছত্রে-ছত্রে গুজরাত সরকার ও প্রশাসনের প্রতি তিরস্কার রয়েছে। এই অপরাধীদের সাজা মকুব করার কোনও অধিকার গুজরাত সরকারের ছিল না। কারণ, ক্রিমিনাল প্রোসিডিয়র কোড (সিআরপিসি) অনুসারে, যে রাজ্যের আদালতে কোনও অপরাধীর সাজা ঘোষিত হয়, একমাত্র সেই রাজ্যের সরকারেরই এক্তিয়ার রয়েছে সে সাজা মকুব করার। বিলকিস বানো মামলাটি ২০০৪ সালে গুজরাত থেকে মহারাষ্ট্রে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কারণ, আদালতে আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট মনে করেছিল যে, গুজরাতে তদন্ত হলে সাক্ষ্যপ্রমাণ বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে, নিরপেক্ষ তদন্তে বিভিন্ন বাধা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কাও আছে। অর্থাৎ, ২০০৪ সালেও শীর্ষ আদালত নাগরিকের নিরপেক্ষ বিচারপ্রাপ্তির গণতান্ত্রিক অধিকারকে রক্ষা করেছিল। প্রসঙ্গত, গুজরাতে তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সোমবার সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, মহারাষ্ট্র সরকারের অধিকার হাতিয়ে গুজরাত সরকার মুক্তি দিয়েছে ধর্ষকদের। অনুমান, রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়েই এমন ঘৃণ্য অপরাধীদের মুক্তি দিতে সরকার এতখানি উদ্গ্রীব ছিল। এই জমানায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর কোনও অপরাধই ধর্তব্য নয়, এই বার্তাটি দেওয়ার তাগিদ ছিল সম্ভবত।
গুজরাত সরকার কী ভাবে আইনের অপব্যবহার করেছে, সুপ্রিম কোর্ট সে দিকেও অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে। আদালত জানিয়েছে, বিভিন্ন ধাপে বিচারবিভাগ, তদন্তকারী সংস্থা এবং প্রশাসনের একাধিক আমলা এই মুক্তির সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন, কিন্তু সেই আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে রাজ্য সরকার। এই অপরাধীদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল রাজ্যের ১৯৯২ সালের একটি নীতি অনুসারে। কিন্তু, ২০১৪ সালে সেই নীতি সংশোধিত হয়ে স্থির হয় যে, ঘৃণ্য অপরাধে অভিযুক্ত অপরাধীদের কোনও পরিস্থিতিতেই শাস্তি মকুব করা হবে না। ২০২২ সালে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নীতির কোন সংস্করণটি অনুসরণ করা বিধেয়, রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা বিলক্ষণ জানেন। তবুও, তাঁরা তামাদি নীতিটিই ব্যবহার করেছিলেন, কারণ নতুন নীতিতে এই অপরাধীদের শাস্তি মকুব হয় না। অভিযুক্তরা সুপ্রিম কোর্টের কাছেও তথ্য গোপন করেছিল বলে উল্লেখ করেছে আদালত— এবং, সেই মিথ্যাচারে বিভ্রান্ত হয়েই ২০২২ সালের মে মাসে শীর্ষ আদালতের দুই বিচারপতি গুজরাত সরকারকে এই অপরাধীদের মুক্তি দেওয়ার কথা বিবেচনা করতে নির্দেশ দেন।
বিলকিস বানোর ধর্ষকরা ফের জেল খাটবে কি না, তার চেয়ে অনেক বড় প্রশ্ন হল, প্রশাসন যদি এমন নির্লজ্জ রকমের পক্ষপাতদুষ্ট হয়, যদি নৈতিকতার শেষ গণ্ডিটুকু অতিক্রম করতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে, তবে গণতন্ত্রকে বাঁচানোর কোন পথ অবশিষ্ট থাকে? কেবলমাত্র শীর্ষ আদালতের উপর নির্ভর করে তো গণতন্ত্র অগ্রসর হতে পারে না— তার আব্রুরক্ষার ভার তিনটি স্তম্ভের উপর সমান ভাবে ন্যস্ত। তবে, জনগণের কাছেও একটি প্রশ্ন থাকে। ধর্ষকরা খালাস পেলে তাদের মিষ্টিমুখ করানোর দৃশ্যও যাদের বিবমিষার উদ্রেক করে না, যে রাজনৈতিক অবস্থান সেই ঘৃণ্য অপরাধীদের নায়কের সম্মান দেয়, তাকে প্রত্যাখ্যান করার কথা মনে হয় না যাদের, দায় কি সেই জনতারও নয়?