বিবাহবিচ্ছেদ। প্রতীকী ছবি।
বিবাহবিচ্ছেদ এক প্রকার ট্র্যাজেডি বটে, কিন্তু এক সঙ্গে থাকা সম্ভব নয় জেনেবুঝেও থাকাটা আরও বড় ট্র্যাজেডি— বিবাহবিচ্ছেদ প্রসঙ্গে বলেছিলেন বিশ্বখ্যাত এক অভিনেত্রী। তিনি হয়তো ভারতের শীর্ষ আদালতের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটি শুনলে খুশি হতেন— ‘বিশেষ পরিস্থিতি’তে বিশেষ অধিকার প্রয়োগ করে বিবাহবিচ্ছেদের পক্ষে দ্রুত সায় দিতে পারে আদালত। বিশেষ পরিস্থিতিটি এ ক্ষেত্রে ‘পুনরুদ্ধারের অসাধ্য বৈবাহিক সম্পর্ক’, ভেঙে যাওয়া কোনও বৈবাহিক সম্পর্ক যখন আর কোনও ভাবেই মেরামত করা সম্ভব নয়। সেই ক্ষেত্রেই সুপ্রিম কোর্ট প্রয়োগ করবে ‘বিশেষ অধিকার’, যা আসলে ভারতীয় সংবিধানের ১৪২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনও বিচারাধীন বিষয়ের ‘সম্পূর্ণ আইনি নিষ্পত্তি’।
ভারতীয় নাগরিকদের বহুলাংশকে যে আইন বিবাহের বৈধতা দেয়, সেই হিন্দু বিবাহ আইন ১৯৫৫ অনুযায়ী, পারস্পরিক সাহমত্যে বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে দু’পক্ষকেই প্রথমে নিম্ন আদালতে আবেদন করতে হয়, যার প্রথম শর্ত আবেদনকারীদের অন্তত এক বছর বা তার বেশি সময় আলাদা থাকা। আবেদন মঞ্জুর হতে আরও অন্তত ছ’মাস সময় লাগত, এই সময়সীমা মেনে চলা ছাড়া আবেদনকারীদের গত্যন্তর ছিল না। বলা হত যে, এই ছ’মাস সময়ের বাধ্যবাধকতা আসলে দুই পক্ষকে দেওয়া আদালতের শেষ সুযোগ— বিচ্ছেদের আবেদন প্রত্যাহারের, সব মিটিয়ে নেওয়ার। আবেদন করা থেকে শুরু করে আরও ছ’মাসের অপেক্ষা, এই পুরো সময়টিই দু’পক্ষের কাছে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়— আবেদন-পূর্ব যন্ত্রণাদীর্ণ সময়ের কথা না-ই বা বলা গেল। বাধ্যতামূলক অপেক্ষার ওই ছ’মাস সময় কমানোরই ইঙ্গিত দিয়েছে শীর্ষ আদালত; বিচ্ছেদের পর সন্তানের দায়িত্ব, সম্পত্তির ভাগ ইত্যাদি বিবেচনা করে বিচ্ছেদের আর্জির দ্রুত মীমাংসার কথা বলেছে। তাতে যন্ত্রণারও কিছুটা দ্রুত উপশম।
বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্ত আবেদনকারী দু’টি মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরকে শুধু গ্রাহ্যই করেনি, গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে। এখানেই বিষয়টি একটি অন্য মাত্রা পায়। সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ আসল কথাটি বলেছে— ভারতে বিবাহবিচ্ছেদ আইনটির ভিত্তিই হল পারস্পরিক দোষারোপ, এ দিয়ে কখনও সম্পর্ক জোড়া লাগে না। বৈবাহিক সম্পর্ক মেরামতির অসাধ্য হলে তা স্বীকার করে নেওয়াতেই ব্যক্তির মঙ্গল, সমষ্টিরও। পরিসংখ্যান মতে ভারতে গত দুই দশকে বিবাহবিচ্ছিন্ন মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে, যদিও বিবাহবিচ্ছেদের জাতীয় হার মাত্র ১.১ শতাংশ। সংখ্যা সব সময় ভিতরের কথাটি বলে না, বৈবাহিক সম্পর্কের অশান্তি-যন্ত্রণারাশি রাশিবিজ্ঞানের আয়ত্তের বাইরে। অবশ্যই বিবেচ্য বিচ্ছেদের আবেদনকারীদের, বিশেষত মেয়েদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের প্রশ্নটিও: ভারতে অগণিত মেয়েকে বিবাহবিচ্ছেদের পর পরিবারহীন, সমাজচ্যুত, কর্মক্ষেত্রে অবমানিত হয়ে জীবন কাটাতে হয়। যে দেশে দারিদ্র প্রবল, লিঙ্গবৈষম্য তারও বেশি, নারীদের বহুলাংশ অর্থনৈতিক ভাবে স্বক্ষম নয়, সেখানে বিবাহবিচ্ছেদ কী দুঃসহ আঘাত নিয়ে আসতে পারে, সহজে অনুমেয়। আদালতের হস্তক্ষেপে বিচ্ছেদের দীর্ঘ ক্লান্তিকর ব্যয়সাপেক্ষ আইনি প্রক্রিয়াটি একটু সহজ হলে তা ব্যক্তির গভীর ক্ষতে অল্প হলেও প্রলেপ দেবে। তা-ই বা কম কী!