সুপ্রিম কোর্ট। ফাইল চিত্র।
পঞ্চাশ বছর আগে, ২৪ এপ্রিল ছিল ভারতীয় গণতন্ত্রের একটি বড় মাইলফলক। বিশেষজ্ঞ মহলের বাইরে হয়তো সে দিন এই ঘটনার বিশাল তাৎপর্য জনগোচর হয়নি। কিন্তু পরবর্তী দশকগুলির ঘটনাবলি বুঝিয়ে দিয়েছে, ‘কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরল সরকার’ নামক মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট সে দিন যে রায়ে পৌঁছেছিল, তার গুরুত্ব কত ব্যাপক ও মৌলিক। ভারতের সংবিধান সংশোধন করার লক্ষ্যে ভারতীয় সংসদের হাতে ক্ষমতা কত দূর, তা সীমাহীন কি না, এই ছিল সে দিনের বিচার্য বিষয়। দেশের দীর্ঘতম মামলায় ১৩ জন বিচারপতি সম্বলিত বেঞ্চে ৬৮ দিনব্যাপী শুনানির পর রায় দাঁড়িয়েছিল— সংসদ তথা শাসনবিভাগ সংবিধানের যে কোনও সংশোধন করতে পারে, যত ক্ষণ পর্যন্ত সংবিধান-প্রদত্ত কতকগুলি মৌলিক অধিকারে হাত না পড়ে। এই অধিকারগুলি একেবারেই মৌলিক, সুতরাং অ-সংশোধনীয় ও অ-পরিবর্তনীয়: সংবিধানের ‘বেসিক স্ট্রাকচার’ বা ‘মূল কাঠামো’ হিসাবেই তা অভিধাযোগ্য। অর্থাৎ, এই রায়ে এক দিকে সংবিধান সংশোধনে সংসদের ক্ষমতা অনেক দূর সমর্থিত হল, অন্য দিকে একটি লৌহযবনিকা টেনে দেওয়া হল তার ‘মূল কাঠামো’ রক্ষার্থে। কেরলবাসী গৈরিকবাস-পরিহিত এক সাধু ভারতের আইন-বিচার ও গণতন্ত্রের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় স্থান দখল করে নিলেন ঐতিহাসিক মামলাটির সূত্রে। গত ২৪ এপ্রিল অর্ধশতক পূর্তির দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সর্বোচ্চ আদালতের তত্ত্বাবধানে শুভ-উন্মোচিত হল একটি স্মরণিকা ‘ওয়েবপেজ’।
মূল কাঠামো-র কতগুলি ক্ষেত্র নির্দেশিত হয়েছিল সে দিন, যেমন যুক্তরাষ্ট্রীয়তা, গণতন্ত্র ও ধর্মাচরণের স্বাধীনতা। পরবর্তী কালে এতে আরও কিছু ক্ষেত্র সংযোজিত হয়েছে, শাসনবিভাগ ও বিচারবিভাগের বহু বিরোধের মধ্যে এক প্রকার দিশা তৈরির প্রয়াস হয়েছে। সে দিনও এই মামলার মধ্য দিয়ে বিচারবিভাগের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের প্রবল দ্বন্দ্বের মীমাংসা হচ্ছিল, যাতে অবশেষে বিচারবিভাগের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রসঙ্গত, তৎপূর্বে ইন্দিরা গান্ধী সরকার পর পর কয়েকটি সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত উল্টে দেয়, যেমন আর সি কুপার মামলা (১৯৭০), মাধবরাও সিন্ধিয়া মামলা (১৯৭০) এবং গোলকনাথ মামলা (১৯৬৭)। ফলত, এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, এই ঐতিহাসিক মামলায় কেশবানন্দ ভারতী নিজে মামলা হেরেও ভারতীয় গণতন্ত্রকে জিতিয়ে দেন— ঐতিহাসিক রায়ে ক্ষমতা-আগ্রাসী কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের হাত থেকে মৌলিক অধিকারকে বাঁচিয়ে।
ঠিক এই কারণেই অর্ধশতক উদ্যাপনটি গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধানের মূল কাঠামোটির মান্যতা রক্ষা করে চলছে না, নানা প্রসঙ্গে এই অভিযোগ উঠছে যখন, তার মধ্যে এই মামলার সূত্রে সংবিধানের অলঙ্ঘ্য মূল কাঠামোটিকে স্মরণ সমগ্র দেশের নাগরিককেই বলীয়ান করে তুলতে পারে। প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের ভাষায়, সংবিধানে উল্লিখিত মৌলিক ব্যক্তি-অধিকারের মূল কাঠামোটিই হল ভারতীয় গণতন্ত্রের ‘ধ্রুবতারকা’। কলেজিয়াম নিয়ে সংসদের সঙ্গে বিচারবিভাগের আজ কঠিন সংঘর্ষ চলছে, আইনমন্ত্রী রিজিজু থেকে উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড় সম্প্রতি আবারও বলেছেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদই প্রধান, আদালত যেন সংসদের কাজে হস্তক্ষেপ না করে। কিন্তু, গণতন্ত্রের অর্থ তো কেবল সংসদমান্যতা নয়, সংবিধানমান্যতা: ব্যক্তি-অধিকার রক্ষাই যার লক্ষ্য। সুতরাং, সেই লক্ষ্যের বিচারবিভাগীয় বিবেচনা ব্যতীত সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত স্বেচ্ছাচারিতার অনৈতিক জবরদস্তিতে পৌঁছতে পারে। পঞ্চাশ বছর আগে সেই আশঙ্কা যত দূর সত্য ছিল, ২০২৩ সালের ভারতে তা অনেক গুণ বেশি। গণতন্ত্রের দীর্ঘজীবিতার স্বার্থেই সংসদের হাত থেকে সংবিধানের মূল কাঠামোটিকে সুরক্ষিত রাখা আজকের প্রথম জরুরি কাজ।