ঘৃণাভাষণ নিয়ে নির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের দাবি তোলার অবকাশ বিরোধীদের আছে। প্রতীকী ছবি।
একাধিক মামলা হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট বার বার তার অবস্থান জানাচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। কারণ, পদক্ষেপ করার দায়িত্বটা শেষ পর্যন্ত সরকারের। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিতে পারে, কিন্তু তা কার্যকর করার ভার শাসনবিভাগের। সম্প্রতি ঘৃণাভাষণ নিয়ে একটি মামলার শুনানিতে স্পষ্ট করেই নিজের ক্ষোভ এবং নৈরাশ্য জানিয়েছে শীর্ষ আদালত। মাননীয় বিচারপতিরা খোলাখুলি বলেছেন, বহু বারই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সুপ্রিম কোর্ট এ নিয়ে তার মত জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় নির্দেশ জারি করেছে। কিন্তু যথোপযুক্ত পদক্ষেপ করা হয়নি। সরকারের দিক থেকে এমত আচরণ অবশ্য মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়। ঘৃণা, বিভাজন এবং বিদ্বেষ যেখানে শাসকের ক্ষমতা দখলের অন্যতম পুঁজি, ঘৃণাভাষণ যেখানে শাসকের প্রশ্রয়ে পুষ্ট এবং অন্যতম হাতিয়ারও বটে, সেখানে সরকার বা প্রশাসন আচমকা শীর্ষ আদালত বলামাত্র ঘৃণাভাষীদের প্রতি খড়্গহস্ত হয়ে উঠবে, এমনটা আশা করা বাতুলতা মাত্র। সুতরাং, নাগরিক সমাজের হাতে রইল পেনসিল। নাগরিক সমাজ বিচলিত হয়ে বারংবার আদালতের দ্বারস্থ হবে, আদালত নির্দেশ জারি করবে এবং সে সব খাতায়কলমে নথিবদ্ধ হয়ে থেকে যাবে। কারণ, নির্দেশ দেওয়া আর নির্দেশ বলবৎ করা, দুটো আলাদা কাজ। প্রথমটা আদালতের, দ্বিতীয়টা সরকারের। আদালত আর সরকারের মধ্যে আর একটি সেতু হল আইনসভা, অর্থাৎ সংসদ। সেখানেও শাসক শিবিরই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু ঘৃণাভাষণ নিয়ে নির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের দাবি তোলার অবকাশ বিরোধীদের আছে। এখনও পর্যন্ত এই মর্মে তেমন ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চোখে পড়েনি।
বস্তুত ঘৃণাভাষণ যে স্বতন্ত্র আইনের বিষয় হয়ে ওঠেনি, সেটা নিজেই অনেক কিছু প্রমাণ করে। ঘৃণাভাষণ আগে ছিল না, এমন নয়। আনন্দ পট্টবর্ধনের একাধিক তথ্যচিত্রে তার প্রামাণ্য ফুটেজ ধরা আছে। কিন্তু চলতি জমানায় দেশ জুড়ে ঘৃণাভাষণ প্রায় যে একটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়েছে, সেটা আগে এ ভাবে দেখা যায়নি বললে সত্যের অপলাপ হয় না। এ ব্যাপারে প্রযুক্তির ভূমিকা অবশ্যই খুব বড়। বৈদ্যুতিন চ্যানেল এবং সমাজমাধ্যমের কল্যাণে ঘৃণাভাষণ আজ একটি লাগাতার জাতীয় আপদে পরিণত। ফলত আইনি পরিসরে এ নিয়ে চর্চা অনিবার্য ভাবেই বেড়েছে। ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯ (২)-এ মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপরে যে সব নিয়ন্ত্রণের কথা বলা আছে, ঘৃণাভাষণে বেড়ি পরানোর সংস্থান রয়েছে তার মধ্যেই। তৎসহ ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩ (ক), ১৫৩ (খ), ২৯৫ (ক) ও ৫০৫ (২) ধারা এবং ভারতীয় জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৮ নম্বর, ১২৩ (৩ক) ও ১২৫ ধারায় ঘৃণাভাষণ প্রতিরোধ ও শাস্তির বিধান আছে। ২০১৪ সালের একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ঘৃণাভাষণের সংজ্ঞা বেঁধে দিয়ে বলেছিল, এ হল এমন এক প্রয়াস যেখানে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে তার গোষ্ঠীপরিচয়ের ভিত্তিতে প্রান্তিক করে দিতে চাওয়া হয়। ওই গোষ্ঠীকে সংখ্যাগুরুর চোখে অবৈধ প্রমাণ করা, তাদের সামাজিক অবস্থানের অবনমন ঘটানো এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা খর্ব করাই তার উদ্দেশ্য। আইন কমিশনের ২৬৭তম রিপোর্টে ঘৃণাভাষণ সংজ্ঞায়িত হয়েছে জাতি, গোত্র, লিঙ্গ, যৌন-রুচির ভিত্তিতে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে ঘৃণার উস্কানি হিসাবে। কিন্তু আইন বিশেষজ্ঞেরা বার বারই বলছেন, এটুকুই যথেষ্ট নয়। আরও সুনির্দিষ্ট আইন প্রয়োজন। ঘৃণাভাষণের বিষ এখন যে মাত্রায় ছড়িয়েছে, তাতে কোনটা ঘৃণাভাষণ আর কোনটা নয়, সেটা ব্যাখ্যার আপেক্ষিকতার উপরে আর ছেড়ে রাখা চলে না, মত প্রকাশের স্বাধীনতার মাত্রা নির্ধারণের উপরেও নয়। নাগরিক সাম্য নিশ্চিত করা এবং বৈষম্য ও বিভাজনের বার্তা প্রতিরোধ করাটাও আশু লক্ষ্য হওয়া দরকার। নচেৎ আদালতের নির্দেশ আর প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে ব্যবধান কমবে না।