দিনমজুরের দল।
সবার জন্য চাকরির ব্যবস্থা না হলে, আর্থিক অসাম্য দূর না হলে স্বাধীনতার শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্কল্প ব্যর্থ হয়ে যাবে, জানিয়েছে তাঁর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের রিপোর্ট। কথাটি শুনে দিনমজুরের দল হয়তো হাসবেন— ব্যঙ্গের হাসি নয়, তাচ্ছিল্যেরও নয়; সে হাসির পিছনে লুকিয়ে থাকবে বহু বেদনা, বহু বঞ্চনার ইতিহাস। এই মানুষগুলি ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান দেখেছেন, সে সম্ভাবনা কম। কিন্তু, রিপোর্টের সময়কালে দেশে যত মানুষ আত্মহত্যা করেছেন, তাঁদের এক-চতুর্থাংশই দিনমজুর, এই কথাটি জানার জন্য শ্রমজীবী মানুষদের এনসিআরবি-র রিপোর্ট দেখতে হয় না। প্রাত্যহিকতা তাঁদের এই সত্যটি জানিয়ে দিয়েছে। আরও উদ্বেগের কথা, গত কয়েক বছরে ধারাবাহিক ভাবে মোট আত্মহত্যায় দিনমজুরদের অনুপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থব্যবস্থার শতবর্ষের লক্ষ্য হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা যে আর্থিক বৈষম্য দূর করার বাণী শুনিয়েছেন, এই পরিসংখ্যানের পাশে তাকে ফাঁপা শোনায়। কেউ বলতেই পারেন যে, যত দুঃখজনকই হোক না কেন, ভারতের বিপুলসংখ্যক দিনমজুর শ্রেণির মানুষের মধ্যে কয়েক জনের আত্মহত্যা থেকে অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য বা চরিত্র বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো চলে না। কথাটির মধ্যে আত্মপ্রবঞ্চনা প্রবল। অর্থনৈতিক সঙ্কট থাকলেই সবাই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন না, এই কথাটি যেমন সত্যি— তেমনই এটাও সত্যি যে, যদি প্রতি চার জন আত্মঘাতী মানুষের মধ্যে এক জন একটি বিশেষ শ্রেণির হন, তবে বুঝতে হবে যে, পরিস্থিতি সঙ্গিন।
সমস্যাটি সমৃদ্ধির নয়, আর্থিক বৃদ্ধির হারেরও নয়— অতিমারির ধাক্কা লাগলেও অর্থব্যবস্থার এমন হাল হয়নি, যাতে কাউকে অনটনে আত্মঘাতী হতে হয়। সমস্যাটি উৎপাদনের নয়, বণ্টনের। সমস্যা রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে। ২০১৪ সালে মনমোহন সিংহের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারকে হারিয়ে নরেন্দ্র মোদীর ক্ষমতায় আসার মধ্যে যে পর্বান্তরটি ঘটেছিল, তার বহু স্তর। তার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ স্তরের কথা রাজনৈতিক ঘোলা জলে সম্পূর্ণ হারিয়ে গিয়েছে— কথাটি হল, আর্থিক বৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পথ কী হবে, সে বিষয়ে এই দুই জমানার মধ্যে দূরত্ব অসেতুসম্ভব। নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর সরকার বাহ্যত বাজারব্যবস্থায় বিশ্বাসী— তাঁরা ‘ট্রিক্ল ডাউন’-পন্থী, অর্থাৎ, উন্নয়নের ফল চুইয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে বলে মনে করেন। দায়ে পড়ে তাঁরা এনআরইজিএ-র মতো প্রকল্প বজায় রাখেন বটে, কিন্তু মানুষকে সরাসরি সমৃদ্ধির ভাগ দেওয়া তাঁদের মতে ‘রেউড়ি’ রাজনীতি। মানুষের আর্থিক বৃদ্ধির ভাগীদার হওয়ার অধিকারের অনস্বীকার্যতা এই জমানায় আর নেই। অথচ, অভিজ্ঞতা বলছে, তাঁরা বাজারের স্বাধীনতাতেও বিশ্বাসী নন— ‘বাজার’ বলতে বর্তমান ভারত বোঝে নিছক সাঙাততন্ত্র।
দিনমজুরদের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান একটি সূচকমাত্র— ভারতে আর্থিক অসাম্য বৃদ্ধি, অধিকতর মানুষের ক্রমশ অভাবের অতলে পৌঁছে যাওয়ার আরও বহু সূচক চোখের সামনেই আছে। নোট বাতিল থেকে জিএসটি, তার পর অতিমারি, হরেক ধাক্কায় নাজেহাল এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের কথা উঠলেই রাজকোষের প্রতিযুক্তি উঠে আসে। সত্যিই রাজকোষ ঘাটতির কথা ভাবা প্রয়োজন। কিন্তু, রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধির সব পথেই কি হাঁটা হয়ে গিয়েছে? কর্পোরেট করে ছাড় দিয়ে যে বিপুল রাজস্ব ক্ষতি হয়, অতি ধনী কৃষকদের আয়করের আওতার বাইরে রেখে সরকার যে রাজস্ব হারায়, সম্পদ কর না থাকায় যে অর্থ রাজকোষে আসে না, সেগুলি আদায় করে গরিব মানুষদের ত্রাণ দেওয়ার কথা কি ভাবা যেত না? প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা শতবর্ষের লক্ষ্য হিসাবে সম্ভবত এই কথাগুলি বলার সাহস করবেন না।