প্রতীকী ছবি।
চোখের জল তুচ্ছ করিবার নহে। দুইটি ডাগর আঁখি বাষ্পাকুল হইলে কেন ত্রিভুবন ওলটপালট হইয়া যায়, সেই অপার রহস্য ভ্যালেন্টাইন’স ডে-র সমস্ত বাণিজ্য অতিক্রম করিয়া এই গ্রহের মানুষ ও মানুষীদের বিস্মিত করিয়া চলিবে। রবীন্দ্রনাথ মিছামিছি তাজমহলকে কালের কপোলতলে এক বিন্দু নয়নের জলের সহিত তুলনা করেন নাই। বিজ্ঞানী বলিতেই পারেন, চোখের জল শরীরের একটি গ্রন্থি নিঃসৃত লবণাক্ত তরলমাত্র, যাহাতে প্রোটিন, এনজ়াইম, হরমোন ইত্যাদি অন্য উপাদান থাকে। অশ্রুপাতের বিবিধ কারণও বিজ্ঞান শারীরক্রিয়া বিশ্লেষণ করিয়াই বুঝাইয়া দিয়াছে। কিন্তু তাহাতে চোখের জলের মহিমা কিছুমাত্র কমিয়াছে কি? কেবল দুঃখে নহে, আনন্দেও কেন চোখে জল আসে, তাহার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা লোকের অজানা নহে, অথচ যে অভিনেতা দিনের পর দিন একই নাটকের দৃশ্যে হাসিতে হাসিতে কান্নায় ভাঙিয়া পড়েন, তাঁহার প্রতি চাহিয়া আজও দর্শকদের বিস্ময়ের সীমা থাকে না। অভিনেতার চোখের জল যে প্রায়শই গ্লিসারিন বা অন্য কোনও উত্তেজকের প্রতিক্রিয়া, তাহা জানিয়াও দর্শকের চোখ, বিনা গ্লিসারিনেই, সজল হইয়া উঠে। সংবেদী মন বুদ্ধি খাটাইয়া অঙ্ক কষিয়া অপরের আবেগে সাড়া দেয় না, সংবেদন আছে বলিয়াই সাড়া দেয়। বিচারবুদ্ধিকে সাময়িক ভাবে ঘুম পাড়াইয়া রাখিয়াই মানবহৃদয় আবেগের জগতে বিচরণ করে।
অভিনয় কি কেবল মঞ্চেই দেখা যায়? ব্যক্তির প্রাত্যহিক জীবন হইতে শুরু করিয়া সমাজ, দেশ বা দুনিয়ার কর্মকাণ্ডেও নিরন্তর কত অভিনয় চলিতেছে, কে তাহার খোঁজ রাখে? বিশেষত, তথ্যপ্রযুক্তি ও বিশ্ববাজারের যৌথ লীলায় রাজনীতির ভুবন যত বেশি জনসমাজের সম্মুখে পরিবেশিত হইতেছে, রাজনীতিকদের আচরণ যত বেশি করিয়া জনপ্রিয় বিনোদনের উপকরণ হইয়া উঠিতেছে, ততই দর্শকরা ধাঁধায় পড়িতেছেন— কোনটি নায়কনায়িকাদের মন কি বাত, কোনটি যত্ননির্মিত চিত্রনাট্যের মঞ্চরূপ, কোনটি আন্তরিক প্রতিশ্রুতি, কোনটি জনমোহিনী জুমলা, নয়নভরা জলে কখন হৃদয়মথিত আবেগের প্রকাশ ঘটিতেছে আর কখন তাহা বিশুদ্ধ কুম্ভীরাশ্রু। রাজ্যসভার বিদায়ী কংগ্রেস সদস্য ও বিরোধী দলনেতা গুলাম নবি আজাদ সম্পর্কে স্মৃতিচারণের সময় নরেন্দ্র মোদী চোখের জল ফেলিয়াছেন। ক্যামেরার সমক্ষে ইহাই তাঁহার প্রথম অশ্রুপাত নহে, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে অন্তত পাঁচ বার তাঁহাকে কাঁদিতে বা কান্না সামলাইতে দেখা গিয়াছে। পূর্বাশ্রমে তিনি কখনও প্রকাশ্যে কাঁদিয়াছেন কি না, তাহা অবশ্য গবেষণার বিষয়। তাঁহার দুর্বলচিত্তের খ্যাতি নাই, তাঁহার যত্ননির্মিত ভাবমূর্তিটি কপাটবক্ষ পুরুষসিংহের ধ্রুপদী ছাঁচে ঢালা। সুতরাং, তাঁহার অশ্রুমোচনের নূতন দৃশ্যটি গুঞ্জন তুলিলে বিস্ময়ের কিছু নাই। গুলাম নবি আজাদ কংগ্রেসের ‘বিক্ষুব্ধ’ শিবিরের সদস্য বলিয়া পরিচিত, কাশ্মীরের রাজনীতিতে তাঁহাকে লইয়া বিজেপির গূঢ় পরিকল্পনার কথাও বাতাসে ভাসিতেছে। দুষ্ট লোকে বলিতে পারে, মোদীজির চোখে সে-দিন যাহা দেখা গিয়াছে তাহা কি তবে আনন্দাশ্রু? দুষ্ট লোকের কথায় কান দিতে নাই। বরং স্মর্তব্য যে, সত্য হউক মিথ্যা হউক, চোখের জল তুচ্ছ করিবার নহে। সব প্রাণীর শরীরে অশ্রু-গ্রন্থিই নাই। এমনকি অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণীও সেই রসে বঞ্চিত। যথা, খরগোশ এবং ছাগল।