ফাইল চিত্র।
কোভিড-অভিজ্ঞতার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদীর প্রথম বিদেশ সফর, মার্চ মাসের ২৬ তারিখে বাংলাদেশে— সে দেশে পঞ্চাশ বৎসরের জয়ন্তী পালন উৎসবে যোগদান করিতে। ঐতিহাসিক ক্ষণ। সফরটিও ঐতিহাসিক। ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক মৈত্রী সম্পর্ক ও দুই দেশের বর্তমান সরকারের সফল বোঝাপড়ার নিশানা যদি এই সফরের মধ্যে বিধৃত থাকে, সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর সফর উপলক্ষ করিয়া তুমুল অশান্তি, সংঘর্ষ ও হিংসার কলঙ্কও ইহাতে যুক্ত হইল। ইতিমধ্যে মুসলিমবিদ্বেষী আখ্যায় ভূষিত প্রধানমন্ত্রীকে কেন বাংলাদেশের শুভ অর্ধশতক জয়ন্তীর মান্য অতিথি করা হইবে, এই ক্রোধে উত্তপ্ত হইয়া উঠিল সেই দেশের চরমপন্থী ইসলামি গোষ্ঠীসমূহ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে কেবল কটূক্তি নহে, সরকারবিরোধী হামলা চলিল। প্রমাণিত হইল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদী নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁহার গত কয়েক দশকব্যাপী প্রয়াসেও সে দেশের কট্টর ইসলামি অংশটিকে দমন করিতে পারেন নাই। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় হিংসাত্মক বিক্ষোভ, ঢাকার বাইতুল মোকররম মসজিদে ভাঙচুর, ভারতীয় হিন্দুস্থানি সঙ্গীতবিশারদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের বাড়ি বিনষ্টির চেষ্টা হইল। অথচ ইতিহাস বলিবে, বাংলাদেশের জন্মের অর্ধশতক পূর্ণ হইবার সময়ে যদি এক জনও বিদেশি অভ্যাগতের সেখানে আমন্ত্রিত হইবার অধিকার থাকে, তাহা ভারতের প্রধানমন্ত্রীরই— আর কাহারও নহে। প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে ধন্যবাদ, বিক্ষোভ ও বিপদের সম্ভাবনা জানিয়াও তাঁহারা সাহস করিয়া উচিত কাজ করিয়াছেন। দুই প্রতিবেশী মিত্রদেশের সম্পর্কে এই মৈত্রী-সোপানটির জরুরি ভূমিকা থাকিয়া যাইবে।
ইতিহাস অবশ্য আরও একটি দুর্ভাগ্য মনে রাখিবে। তাহা হইল, ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁহার কোভিডকালীন প্রথম বিদেশ সফরটিকে সচেতন ভাবে ব্যবহার করিলেন ঘরোয়া রাজনীতির সুবিধার্থে। সেখানে এমন অনেক কথা তিনি বলিয়াছেন, এবং অনেক কাজ করিয়াছেন, যাহা স্পষ্টতই পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী স্বার্থে— বুঝিতে অসুবিধা নাই। নতুবা এই সফরে মতুয়া সম্প্রদায়ের চিত্তাকর্ষণহেতু মন্দির সফরের কোনও যুক্তি থাকিতে পারে না, ইহা তাঁহার প্রথম কিংবা শেষ বাংলাদেশ সফর নহে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের নিকট অভিযোগ লইয়া গিয়াছেন। আইনত অভিযোগের কোনও ভিত্তি থাকুক বা না থাকুক, নৈতিকতার মানদণ্ডে প্রধানমন্ত্রীর এই ক্রিয়াকলাপ আপত্তিকর, এবং অভূতপূর্ব রকমের আপত্তিকর। ইহার আগেও প্রধানমন্ত্রী মোদী আমেরিকার মাটিতে নিজের দেশের কথা না বলিয়া নিজের দলের কথা বলিয়াছিলেন। অবশ্য তখন নির্বাচন ছিল না। দেশের কোনও গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই ভাবে আন্তর্জাতিক মাটিকে ব্যবহারের মধ্যে এমন এক সঙ্কীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি আছে, যাহা ভারতের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করিল।
পঞ্চাশ বৎসর বয়সি দেশটির সহিত ভারতের যেমন সুসম্পর্ক প্রবহমান, তেমনই কতগুলি গুরুতর অমীমাংসিত সমস্যা আজও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে কণ্টকিত রাখিয়াছে— যে কণ্টকে কেবল কূটনীতি নহে, দুই দেশের জনসমাজও ক্রমাগত বিদ্ধ হইতেছে। বাংলাদেশের সহিত সুসম্পর্কে সত্যই বিশ্বাস রাখিলে সেই সংবেদনশীল বিষয়গুলিতে সমাধানের পথে হাঁটিতে হইবে। আর তাহা না করিয়া কেবল দলীয় স্বার্থ মাথায় রাখিয়া চলিলে সম্পূর্ণ উল্টা ফল ফলিবে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতালাভের দিকে তাকাইয়া বাংলাদেশের সহিত সম্পর্ক রাখা কোনও পক্ষের জন্যই লাভজনক হইতে পারে না— ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা নরেন্দ্র মোদী এই কথাটি না বুঝিতে পারেন। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও কি তাহা বুঝিবেন না?