—প্রতীকী চিত্র।
বিপদ নিয়ে খেলার অভ্যাসটি এ শহরের মজ্জাগত। তাই তীব্র লাউডস্পিকার, শব্দবাজির মতো বিপজ্জনক জিনিসের ব্যবহার দেশের অন্য অনেক শহর রুখে দিতে পারলেও কলকাতা পারেনি। সম্প্রতি সেই তালিকায় নতুন সংযোজন চিনা মাঞ্জার অবাধ ব্যবহার। মাঞ্জা শুধু বিপজ্জনকই নয়, প্রাণঘাতীও বটে। নাইলনের সুতোর উপর ধাতু ও কাচের গুঁড়োমিশ্রিত মাঞ্জার সুতো ব্লেডের মতো ধারালো। ইতিপূর্বে উড়ালপুলের উপর চিনা মাঞ্জার সুতোর আঘাতে বাইক-আরোহীর মারাত্মক আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির ঘটনা বেশ কয়েক বার ঘটেছে। তবে, বিপদ এখন শুধুই উড়ালপুলে নয়, রাস্তায়, এমনকি বাড়ির ছাদেও নেমে এসেছে। চলতি বছরেই শুধুমাত্র কলকাতা শহরে এই কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ছয়, গুরুতর আহত অন্তত ১৭। বিশ্বকর্মা পুজোর কালে এবং প্রাক্-দুর্গোৎসবের মুহূর্তে শাণ দেওয়া মাঞ্জায় ওড়া ঘুড়ির ঝাঁক আরও দুর্ঘটনার আশঙ্কার বৃদ্ধি করছে। তা সত্ত্বেও এখনও এই শহর নিরুত্তাপ।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে জাতীয় পরিবেশ আদালত দেশ জুড়ে চিনা মাঞ্জা নিষিদ্ধ করেছিল। প্রতিটি রাজ্যের মুখ্যসচিবকে এই নির্দেশ অবিলম্বে কার্যকর করতে বলা হয়েছিল। তদনুসারে দিল্লিতে এক বছরের জেল এবং পাঁচ লক্ষ টাকার জরিমানার কড়াকড়ি করা হয়েছে। কড়া পদক্ষেপ করা হয়েছে মধ্যপ্রদেশেও। কিন্তু এ শহরে তার প্রতিচ্ছবি কই? অবশ্য, শব্দবাজির উদাহরণ ভাবলে পুলিশ-প্রশাসনের এ-হেন নির্লিপ্তি এবং অকর্মণ্যতায় আশ্চর্য বোধ হয় না। প্রতি বারই দুর্ঘটনা যখন ঘটে, রেওয়াজ মেনে কিছু লোকদেখানো ধরপাকড় এবং নজরদারি চলে। তার পর ফের বেআইনি কাজকারবার সদর্পে ফেরত আসে। ব্যবসায়ীরা জানেন, কোন মন্ত্রে পুলিশের চোখ ফাঁকি দেওয়া সহজ, পুলিশও সম্ভবত সেই ফাঁকটুকু সচেতন ভাবে রেখেই আইন পালনের প্রহসনটি করে যায়। অথচ, প্রকৃত আইন মেনে চললে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ১৮৮ ধারায় ব্যবস্থা করা যায়। জিনিস বাজেয়াপ্ত করার সঙ্গে তাঁকে গ্রেফতারও করা যায়। কিন্তু সেই ধারায় আজ অবধি কত জন শাস্তি পেয়েছেন, তার প্রকৃত হিসাব কি আইনরক্ষকদের কাছে আছে? নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কী করে প্রকাশ্য দিবালোকে সেই সুতো বিক্রি হচ্ছে শহর ও শহরতলিতে? বেআইনি বিপজ্জনক যে কোনও ব্যবসা নিয়ে প্রশ্ন তুললেই অবধারিত ভাবে বিক্রেতাদের রুজিরোজগারের প্রশ্নটি প্রশাসনের তরফে সামনে রাখা হয়। কিন্তু যে সুতোয় শিশুর প্রাণসংশয় হয়, তার জন্য কোনও আর্থিক অজুহাত যথেষ্ট হতে পারে না। তবে কেন এই ব্যবসা এখনও বন্ধ করা গেল না?
মাঞ্জার বিপদ শুধুমাত্র মানুষেরই নয়, এর সর্বাধিক শিকার পাখিরা। অবশ্য যে সরকার মানুষের প্রাণসংশয় নিয়েই ভাবে না, সে ‘সামান্য’ পাখির মৃত্যু নিয়ে বিচলিত হবে, এমন আশা করাও অনুচিত। ইতিপূর্বে রবীন্দ্র সরোবরে ছটপুজো বন্ধের আবেদনে পরিবেশবিদরা জলাশয় দূষণের পাশাপাশি ধোঁয়া, বাজির কারণে সরোবরের পার্শ্ববর্তী গাছগুলিতে পাখিদের বিপদের প্রসঙ্গও তুলেছিলেন। তার বিপরীতে সরকারি যুক্তি ছিল— উৎসব পালনের দীর্ঘ দিনের রীতি। পরিবেশ ও বন্যপ্রাণের প্রতি সরকারি ‘সচেতনতা’র বহর এতেই ধরা পড়ে। মাঞ্জার ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হবে না। বরং অন্যথা-র জন্য আরও কত রক্তপাত সইতে হবে শহরকে, সেটাই দেখার।