চাঁদের মাটিতে চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার বিক্রম এবং রোভার প্রজ্ঞান। —ফাইল চিত্র।
এত যজ্ঞ কেন? চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে ইসরো-র গবেষণাযান রোভার ও প্রজ্ঞানের সাফল্য কামনায় দেশের দিগ্দিগন্তে যজ্ঞের ধুম পড়ার কারণ কী? বারাণসী, মাদুরাই থেকে কলকাতার সর্বজনীন পূজামণ্ডপ সর্বত্র চন্দ্রাভিযানের সাফল্যকামনায় ইষ্টিযাগ চলছে। এমনকি চাঁদকে হিন্দু রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করার জল্পনাও একবিংশ শতকের ভারতের শাসক দল-পোষিত বৃত্ত থেকে ভেসে আসছে। ভারতীয় সমাজে আধ্যাত্মিক বিশ্বাস কোনও নতুন বিষয় নয়। আচারবিচার তো নয়ই। কিন্তু এই মুহূর্তে এই দেশে বিজ্ঞান নিয়ে যা চলছে, তা মাথা হেঁট করে দেওয়ার মতো। আজকের তুমুল পশ্চাৎমুখী সংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসে নিমজ্জন, এবং পাশাপাশি বিজ্ঞানে অগ্রগতির এই সাফল্যের মধ্যে যাঁরা ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতির একটি অনন্য বিশিষ্টতা দেখছেন— তাঁদের কয়েকটি কথা মনে করিয়ে দেওয়া খুব জরুরি।
প্রথমত, বিশ্বাস কিংবা আচারবিচারের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনও বিরোধ আছে কি না, সেটা আসল প্রশ্ন নয়। বহু দিন ধরে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা চলছে, নানা সমাজে, নানা সভ্যতায়। সেই সন্ধান চলুক— এক কথায় তার নিষ্পত্তি হবে না। কিন্তু এই একুশ শতকের ভারতে যেটা চলছে সেটা কেবল বিশ্বাস কিংবা আচারবিচার নয়, বরং বিশ্বাস বা আচারবিচারকে লোকসমক্ষে আরও অনেক বড়, গুরুতর ও জরুরিতর করে দেখানো এবং অন্যান্য মতামতকে ছোট ও বাতিলযোগ্য বলে দেখানোর আকুলব্যাকুল প্রয়াস। মহাকাশযানের জন্য যজ্ঞ থেকে শঙ্খবাদন ইত্যাদি কোনও বিশ্বাসের আবশ্যিক প্রকাশ নয়— স্রেফ ছবি তোলার বাহানা, সমাজমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমের দিকে লক্ষ্য রেখে। বিদেশনেতাকে আলিঙ্গন থেকে শুরু করে মুসলিম বালকপীড়ন, সর্ব ক্ষেত্রেই যে একই ধারা— চন্দ্রযানের ক্ষেত্রেও সেটাই। যজ্ঞের পাশাপাশি চন্দ্রযানের সাফল্যের পর ইসরোর শাড়ি-পরা বিজ্ঞানীদের ছবি যে এখন ভাইরাল, তাও এই লক্ষ্য পূরণ করতেই। বৈজ্ঞানিকরা নন— রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা এবং তাঁদের অধীন সমাজই এখন দেশের সকল প্রকল্পের, বিজ্ঞান প্রকল্পেরও, নেতৃত্বে।
দ্বিতীয় কথা, ভারতীয় সমাজে ধর্মাচরণ যে-হেতু কোনও নতুন বিষয় নয়, দেশের ধর্মস্থানে বরাবর যজ্ঞ চলে আসা সত্ত্বেও যে-হেতু স্বাধীন ভারতের সাত দশকে ইসরো-র কার্যকলাপের উপর সে সবের কোনও প্রভাব পড়েনি— আজ এই প্রভাব এত গুরুতর হয়ে ওঠার বৃহত্তর অর্থটি বুঝে নেওয়া জরুরি। যে নেহরু-যুগের মুণ্ডপাত করে আজ মোদী-যুগের মাহাত্ম্যকীর্তন চলছে— মনে রাখতে হবে সেই নেহরু-যুগই কিন্তু আজকের ভারতীয় বিজ্ঞানসাফল্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল। আজকের চন্দ্রযান কিংবা ইসরো-র কৃতিত্ব সেই আধুনিকমনস্ক বিজ্ঞান-গবেষণারই ফল। তাতে মন না দিয়ে মন্দির-মসজিদ-যজ্ঞের কূটকচালিতে দেশের প্রথম সত্তর বছর অতিবাহিত হলে ছিয়াত্তরতম বছরটিতে চন্দ্রযানের এই সাফল্য একেবারে অসম্ভব হত। বাস্তবে অতীত ঘটনার উল্টো দিকে গিয়ে প্রমাণ দেওয়া যায় না, তাই তর্কে প্রবৃত্ত হতে হয়। কিন্তু ভবিষ্যৎ হয়তো পরে একটি ‘প্রমাণ’ হয়ে উঠতে পারে। যদি এই যাগযজ্ঞ শাড়িশঙ্খ দিয়েই বিজ্ঞানসাধনার গুণমান বিচার অব্যাহত থাকে, তা হলে সত্তর বছর পর ভারত যেখানে গিয়ে দাঁড়াবে— সেটাই হবে এই বক্তব্যের ‘প্রমাণ’।