কলকাতা হাই কোর্টের মাননীয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ ও তার পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞানের স্রোত যে মহাপ্লাবনের আকার ধারণ করেছে, তাতে তীব্র বিরাগ এবং ক্রোধের সঞ্চার অত্যন্ত স্বাভাবিক। যে বিচারকরা প্রতিনিয়ত এই সব অভিযোগ ও তার সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনা করে চলেছেন, তাঁদের মানসিক প্রতিক্রিয়া যদি অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছয়, সেটাও নিতান্তই সঙ্গত; বিচারপতিও রক্তমাংসের মানুষ। তবে প্রশ্ন একটি থেকে যায়। প্রশ্নটি আবেগ নিয়ে নয়, সেই আবেগের প্রকাশ নিয়ে। কলকাতা হাই কোর্টের মাননীয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে নিয়োগ-দুর্নীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগের বিচার প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নির্বাহ করে আসছেন। এই বিষয়ে তাঁর তৎপর এবং সক্রিয় আগ্রহ কেবল মামলায় জড়িত বা সংশ্লিষ্ট মহলের নয়, বৃহত্তর জনসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর উচ্চারিত নানা উক্তি নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে যে, বিচারপতির আসনে বসে কি আপন শব্দ, বাক্য এবং ভাষাভঙ্গিকে অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত রাখাই কাম্য নয়? সম্প্রতি তাঁর কণ্ঠে এমন আরও কিছু মন্তব্য শোনা গিয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে— বিচারপতির অধিকার এবং মর্যাদাকে একশো শতাংশ সম্মান জানিয়েই— আরও এক বার প্রশ্নটি উত্থাপন করা সমীচীন। বিচারব্যবস্থা ভারতীয় গণতন্ত্রের বড় ভরসা, সম্ভবত শেষ ভরসা। সেই কারণেই বিচারপতিদের কাছে সমাজের প্রত্যাশা অপরিসীম।
সাম্প্রতিক কালে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বারংবার জানিয়েছেন, তিনি এই দুর্নীতি-পারাবারের শেষ দেখে ছাড়বেন, অন্যায়কারীরা কেউ পার পাবে না। বিশেষত, মাননীয় বিচারপতির কয়েকটি উচ্চারণে অনেক নাগরিকের মনে এই ধারণা তৈরি হয়েছে যে, দুর্নীতির অভিযোগে যাঁরা ইতিমধ্যেই চিহ্নিত হয়েছেন, বিশেষত তদন্তকারী সংস্থা যাঁদের আটক করেছে, তাঁরাই শেষ নন, আরও ‘বড়’ মাপের লোকেরাও অতঃপর তদন্তের জালে ধরা পড়বে। তিনি কখনও বলেছেন, এই অনাচারের পিছনে ‘অন্য মাথা’ কাজ করেছে; কখনও জানিয়েছেন, এর পরে ‘অনেক ধেড়ে ইঁদুর বেরোবে’। এই ধারাতেই গত মঙ্গলবার তাঁর কণ্ঠে শোনা গিয়েছে আরও একটি চমকপ্রদ কথা। ২০১৬ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের সম্পূর্ণ তালিকাই বাতিল করার হুঁশিয়ারি দিয়ে মাননীয় বিচারপতি মন্তব্য করেছেন, “ঢাকি সমেত বিসর্জন দিয়ে দেব।” ঢাকি কে বা কারা? এই প্রশ্নের উত্তরে তাঁর বক্তব্য: “পুরো প্যানেল যে-দিন বাতিল করব, সে-দিন ঢাকি শব্দের অর্থ বোঝাব।”
এই ধরনের উক্তি যদি কেবলমাত্র আবেগের প্রকাশ না হয়, তবে তার উদ্দেশ্য হতে পারে অপরাধীদের মনে ভীতির সঞ্চার করা। সে ক্ষেত্রে মাননীয় বিচারপতি সমীপেষু সবিনয় নিবেদন: ন্যায়দণ্ড যাঁর হাতে, অপরাধীকে ভীতিপ্রদর্শনের প্রয়োজন তাঁর হবে কেন? ওই দণ্ডটিই কি অপরাধীর মনে শঙ্কা জাগানোর যথেষ্ট কারণ নয়? বস্তুত, এই ভাবে ভয় দেখানোর আয়োজন কার্যক্ষেত্রে বিপরীত ফল দিতে পারে। কেবল অপরাধীরা নয়, সাধারণ ভাবে নাগরিকরা যদি ভাবতে শুরু করেন যে, বিচারপতিরা মুখে যতটা ভয় দেখান কার্যত তাঁদের বিচার শেষ অবধি ততটা কঠোর হয় না, তা হলে বিচারব্যবস্থার সামাজিক মর্যাদায় বড় রকমের হানি ঘটতে পারে। এই আশঙ্কা সত্য না হলেই মঙ্গল, কিন্তু আশঙ্কাটুকুই কি যথেষ্ট ভীতিপ্রদ নয়? মাননীয় বিচারপতির কাছে একটি শেষ প্রশ্ন। শিক্ষার হাল এ রাজ্যে এমনিতেই ভাল নয়, বিশেষত অতিমারির ধাক্কায় ও সরকারের ঔদাসীন্যে তার শোচনীয় অধোগতি ঘটেছে। প্রশাসনের যে তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই, তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট। আদালতেও যদি শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্তগুলি বিপুল আকারে বাতিল হতে থাকে, সেই সঙ্কট আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে না তো?