জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। —ফাইল চিত্র।
খাদ্য দফতরে বিপুল দুর্নীতির যে ছবি সামনে আসছে, তাতে রাজ্যবাসীর বিস্ময়, আতঙ্ক ও বিরক্তির সীমা না থাকাই স্বাভাবিক। আদালতে জনৈক মন্ত্রী অভিযুক্ত হতে পারেন, জনগণের কাছে অবশ্য জবাবদিহি করতে হবে রাজ্য সরকারকেই। সরকারের বরাদ্দ চাল পাচারে জড়িত ‘সিন্ডিকেট’ চলেছে স্বয়ং তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রীর ‘প্রশ্রয়ে’, এমনই অভিযোগ কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি-র। রাজকোষের টাকায় কেনা দামি চালের পাচার, নিম্ন মানের চাল আমদানি করে রেশনে সরবরাহ, চাল-বিক্রির ভুয়ো রসিদ— ইডি-র তদন্তে এ সবের বেশ কিছু তথ্যপ্রমাণ উঠে এসেছে বলে জানা যাচ্ছে। এগুলির কিছুই কি কখনও রাজ্য প্রশাসনের চোখে পড়েনি? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য এই তদন্তকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন। এই দাবি সত্যি হলে ইডি-র উদ্ধার করা টাকা, ঘুষ দেওয়ার প্রমাণস্বরূপ নথিপত্র, সাক্ষ্য, সবই ভুয়ো বলে প্রমাণিত হতে হবে আদালতে। কিন্তু ইতিমধ্যেই যে পরিমাণ সাক্ষ্যপ্রমাণ নজরের সামনে, তাতে বোঝা যায় নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘন করে যে চক্র চলমান, তাতে রাজনৈতিক মদত যথেষ্ট। দ্বিতীয়ত, স্কুলশিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতির যে ছবি ইতিমধ্যেই সামনে এসেছে, যে ভাবে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠদের বাড়ি থেকে টাকা, নথিপত্র উদ্ধার হয়েছে, তাতে দুর্নীতির প্রকরণের একটি স্পষ্ট ছবি ফুটে ওঠে। গরুপাচার কাণ্ডেও একই অনাচারের ছায়া— অভিযোগ যে, বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল অবৈধ টাকা লেনদেন করেছেন তাঁর কন্যা, দেহরক্ষী, হিসাবরক্ষক প্রমুখের মাধ্যমে। এ দিকে প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ অবৈধ টাকা লেনদেনের। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পদের অভিযোগ শোনা গিয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই। সব মিলিয়ে যে নকশাটি নাগরিকের চোখের সামনে ফুটে ওঠে, তা ভাল লাগার মতো নয়।
লক্ষণীয়, অভিযুক্তরা কেউ ছোটখাটো নেতা নন, তৃণমূল কংগ্রেসের এক-এক জন প্রধান মুখ। এও লক্ষণীয় যে, অভিযুক্ত হওয়ার পরও তাঁদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রী নিজের সমর্থন প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেছেন। সে ক্ষেত্রে কিন্তু অভিযোগের উত্তর দেওয়ার দায়ও শাসক দলের, তথা প্রশাসনের উপর ন্যস্ত হয়। এত দীর্ঘ সময় ধরে এত বিশাল অঙ্কের টাকার দুর্নীতির জাল ছড়ানো হয়েছিল, রাজ্য প্রশাসন কি সে সম্পর্কে কিছুই জানত না? নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে যেমন বহু দিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন চাকরি-বঞ্চিত মানুষেরা, তেমনই গত দশ বছরে বার বার রেশনে নিম্নমানের, পোকা-ধরা চালের বিরুদ্ধে জেলায় জেলায় বিক্ষোভ করেছেন গ্রাহকরাও, রেশন ডিলারের বাড়িতে চড়াও হয়েছেন। সংবাদে তার লাগাতার প্রমাণ মিলেছে। পুলিশ-প্রশাসন এই অভিযোগগুলিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করেনি কেন? যে কোনও অভিযোগকে বিরোধীদের চক্রান্ত বলে শাসকরা নস্যাৎ করেছেন কেন?
আরও একটি প্রশ্ন। কেন্দ্র তার বরাদ্দের হিসাব তলব করছে বলে দেখা যাচ্ছে, একশো দিনের কাজে টাকার হিসাব মিলছে না, আবাস প্রকল্পের তালিকায় বিস্তর জল, রেশনের জন্য কেন্দ্রের বরাদ্দ (সম্ভবত) নয়ছয় হয়েছে। রাজ্য সরকার এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশে যথেষ্ট সরব ও সক্রিয়। কিন্তু বিপরীতে, রাজ্যের বরাদ্দের হিসাব কতটুকু মিলিয়ে দেখা হচ্ছে? বর্তমান রাজ্য সরকার তার নিজস্ব প্রকল্প নির্মাণ করে রাজকোষ থেকে প্রচুর অর্থ খরচ করছে। এ দিকে সরকারি দফতরগুলির বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ বন্ধ করা, অভিযোগের তদন্তে অনীহা, এমনকি রাজ্য সরকারের নিজস্ব প্রকল্পে বাজেট-বহির্ভূত বরাদ্দের ক্রমবৃদ্ধি চলছে— যা যুগপৎ আশঙ্কা ও উদ্বেগের কারণ। রাজ্য সরকারের কর্তব্য, রেশন-সহ সব সরকারি প্রকল্পের বিশদ হিসাব জনসমক্ষে পেশ করে নতুন করে রাজ্যবাসীর আস্থা অর্জন করা। স্বচ্ছতার পুনরায়োজন করা। দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে, প্রশাসনের বিরুদ্ধে এমন সন্দেহের অবকাশ তৈরি না করা। সে কর্তব্য সাধিত হবে কি?