প্রতীকী ছবি।
২০০১ সালে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে দুষ্কৃতীদের হাতে গণধর্ষিতা হইয়াছিলেন এক মহিলা। তিনি ধর্মপরিচয়ে হিন্দু। দীর্ঘ মামলা-শেষে ২০১১ সালে অপরাধীগণ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। তাহার পরেও কাটিয়া গিয়াছে দশ বৎসর, পড়াশোনা শেষে তিনি চাকুরি করিয়াছেন, এমনকি সংসদীয় রাজনীতিতে যোগদানের প্রয়াসও। দুর্ভাগ্য, দুই দশক পুরাতন সেই হিংস্রতার স্মৃতি তাঁহার পিছু ছাড়িল না। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিজেপি-সমর্থকরা যে গান বাঁধিয়াছেন, তাহাতে এই নারীর উল্লেখ আছে। তিনি স্বভাবতই ক্ষুব্ধ— অন্য রাষ্ট্রের এক রাজনৈতিক দল ভোটের আবহে নির্মিত ও প্রচারিত গানে কোনও অনুমতির ধার না ধারিয়াই তাঁহার নাম ও ছবি ব্যবহার করিতেছে, তাঁহার জীবন লইয়া রাজনীতি করিতেছে। সেই গানের ভিডিয়োয় বার বার ফিরিয়া আসিয়াছে একটি কথা, সেই ‘ছোট্ট মেয়ে’র খবর কেউ রাখে না। তিনি সঙ্গত প্রশ্ন তুলিয়াছেন, এই গানের নির্মাতাই কি তাঁহার খবর রাখিয়াছেন?
খবর ‘রাখিবার’ প্রয়োজন নাই, খবর ‘ব্যবহার করিবার’ প্রয়োজন আছে। ধর্ষণের ন্যায় ঘটনা হইতে হিন্দু-মুসলিম বিভেদের সারটুকু গানে ঢালিয়া দিয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসিদ্ধিই লক্ষ্য। নচেৎ কুড়ি বৎসর পূর্বের, এবং অন্য দেশের এক প্রান্তের একটি ঘটনাকে বাছাই করিয়া তুলিয়া আনার কোনও কারণ থাকিতে পারে না। ধর্ষণ-রাজনীতির এই ব্যবহার কেবল অপ্রাসঙ্গিকই নহে, ভিন্দেশের ঘটনাকে নিজ দেশে কার্যসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করা নির্বাচনী বিধিরও বিরোধী। তবে সময় ও সুযোগ বুঝিয়া বাছাই বিষয়ের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবহার তো এই প্রথম নহে— এই কাজে বিজেপির সমর্থক-কর্মী, নেতা এমনকি প্রধানমন্ত্রীও দক্ষ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা রীতিমতো তালিকা প্রস্তুত করিয়া দেখাইয়াছেন, নরেন্দ্র মোদী এমন সব পরিসর হইতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দলীয় রাজনীতির বার্তা দিয়াছেন, যেখানে তাঁহার প্রকৃত পরিচয় থাকিবার কথা ছিল দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে, দেশের প্রধানমন্ত্রী রূপে। তাঁহার আমেরিকা-সফরেও রাষ্ট্রীয় কূটনীতিতে অঙ্গাঙ্গি মিশিয়া ছিল প্রবাসী বিজেপি-সমর্থকদের প্রত্যক্ষ প্রণোদনা দান ও ভারতের নির্বাচন সংক্রান্ত প্রচার। আলাদা করিয়া এখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গকে তুলিবার কারণটিও স্পষ্ট। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে দেশভাগ ও তজ্জনিত জনবিভাজনে জোর দিতেছে বিজেপি, সিএএ চালু করিবার পশ্চাৎপট হিসাবে দেখাইতেছে বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘু মানুষের দুরবস্থা, অনুপ্রবেশের প্রবণতাকে। তথ্য-পরিসংখ্যান কিন্তু বাংলাদেশ হইতে অনুপ্রবেশের ভিন্ন চিত্র দেখাইতেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরকে ছাপাইয়া যাওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতি নাগরিকদের সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতি দিয়াছে।
ভারতের সমস্যা প্রসঙ্গে অন্য দেশ প্রশ্ন তুলিলে কিন্তু বিজেপি ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ বলিয়া গোসা করে, কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রদূতকে ডাকিয়া কড়া কথা শুনায়। অথচ বিশ বৎসর পূর্বে বাংলাদেশের ধর্ষণের ঘটনা সমর্থকরা দলীয় গানে জুড়িলে তাহাদের আপত্তি নাই। নিজ স্বার্থ হাসিল করিবার কৌশলে কোনও রাখঢাক নাই। ভোট-আবহে ধর্মবিভাজনকে কাজে লাগাইয়া জনসমর্থন আদায়ের এই অলজ্জ পন্থা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। ইহা আগুন লইয়া খেলা নহে, ঘরে আগুন লাগাইবার চেষ্টা।