কেহ প্রভাবশালী হইলেও যে যৌন হয়রানি করিয়া থাকিতে পারে, এম জে আকবর বনাম প্রিয়া রামানি মামলার রায় ঘোষণার কালে দিল্লির আদালতের এই পর্যবেক্ষণটি অতিশয় তাৎপর্যপূর্ণ। আকবর মোদী সরকারের রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, তৎপূর্বে সংবাদপত্র সম্পাদক। আইনের হাত যতই দীর্ঘ হউক, তাঁহার মতো ক্ষমতাবানদের স্পর্শ করিতে পারে না— এই ধারণা সমাজে শিকড় গাড়িয়াছে। ‘মি টু’ ঢেউ ভারতে আছড়াইয়া না পড়িলে হয়তো তাহা নড়িত না। এই আন্দোলনে শামিল মেয়েরা সমাজমাধ্যমে তাঁহাদের নিগ্রহকারীর পরিচয় ও কীর্তি প্রকাশ করিয়াছেন। অনেকের অভিজ্ঞতা সম্মুখে আসিতে স্পষ্ট হইয়াছে, একই প্রকারে, এমনকি কখনও একই ব্যক্তি, বহু মহিলাকে হেনস্থা করিয়াছেন। কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলিউডের প্রযোজক হার্ভি ওয়েনস্টাইনের বিরুদ্ধে চলচ্চিত্র জগতের আশি জন মহিলা নিগ্রহের অভিযোগ করেন। আকবরের ক্ষেত্রেও তেমনই ঘটিয়াছে। ২০১৮ সালে প্রিয়া রামানি যৌন নিগ্রহের অভিযোগ প্রকাশ করিতে মানহানির মামলা করিয়াছিলেন আকবর। প্রিয়াকে সমর্থন করিয়া নিজেদের নিগ্রহের ঘটনা প্রকাশ করেন আরও অনেক মহিলা সাংবাদিক। অনুমান করা চলে, প্রতিপত্তির জোরে নিজেকে যাবতীয় আইনের ঊর্ধ্বে ভাবিবার ধৃষ্টতাই কোনও কোনও ব্যক্তিকে বারংবার অন্যায় করিয়া চলিবার সাহস জোগায়।
দিল্লির আদালতের রায় কেবল প্রিয়া রামানিকে মর্যাদাই দেয় নাই, ভারতে ‘মি টু’ আন্দোলনের সারবত্তাও প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়া, সরাসরি তাহাকে ‘অপরাধী’ বলিয়া চিহ্নিত করা আইনসঙ্গত নহে। তাহা অন্যায়ও মনে হইতে পারে। কিন্তু ন্যায় বিচার পাইবার পদ্ধতিগুলি কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির প্রতিকারে প্রায়ই কার্যকর নহে। সেগুলিকে নিষ্ক্রিয় করিয়া রাখা হইয়াছে। এই অপরাধ প্রতিরোধে আইন হইয়াছে ২০১৩ সালে। কিন্তু আইন থাকিলেও অধিকাংশ নিয়োগকর্তা তাহা পালন করেন না, অথবা আইনরক্ষার অভিনয় করেন শুধু। নানা সমীক্ষায় ধরা পড়িয়াছে, অভিযোগ করিলে মেয়েদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাজ ছাড়িতে হইয়াছে, অথবা তাঁহাকে বদলি করা হইয়াছে। অভিযুক্তের শাস্তি হয় নাই, হইলেও তাহা যৎসামান্য। পুরুষতন্ত্রের ভূত প্রবল পরাক্রমশালী।
#মিটু সেই অ-বিচারের প্রতিবাদ। তাহাকে মান্যতা দিল দিল্লির আদালত। বলিল, যে কোনও মঞ্চে অভিযোগ জানাইতে পারেন মেয়েরা। চাহিলে, বহু বিলম্বেও নিগ্রহের কথা প্রকাশ করিতে পারেন। অভিযুক্তের সম্মানরক্ষা করিতে গিয়া মেয়েদের মর্যাদা খর্ব করা চলিবে না। আদালত সংবিধানদত্ত অধিকার মনে করাইয়াছে। কিন্তু বাক্যে অথবা আচরণে মেয়েদের অসম্মান যে অপরাধ, সমাজ সেই সত্যটি আজও অন্তর হইতে গ্রহণ করে নাই। ‘মি টু’ আন্দোলন সম্মানজনক, সুরক্ষিত কর্মক্ষেত্র পাইবার আন্দোলন। গৃহে অথবা বাহিরে, যাহাই হউক মেয়েদের কর্মস্থল, সেখানে তাঁহাদের সঙ্কুচিত, ভীত না থাকিতে হয়— কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধক আইন তাহাই প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। তাহার ব্যবহারে মেয়েদের সাহসী হইতে হইবে। আন্দোলনের শরিক মেয়েরা এই আশ্বাস জুগাইলেন যে, নির্ভয়ে সত্যকথনের ক্ষমতা অতি বলশালীকেও নতজানু করিতে পারে।