—ফাইল চিত্র।
নামেই পতিতোদ্ধারিণী, বাস্তবে দূষণের ধাক্কায় ক্রমশ কলুষিত হচ্ছে গঙ্গা। পুজো, বিবিধ ঘাটে আরতির আয়োজন— নদীকে ঘিরে ঘটনার ঘনঘটা সুপ্রচুর। অথচ, বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা সত্ত্বেও যে তাকে প্রতিনিয়ত নির্মাণ-বর্জ্য, শিল্প-নিঃসৃত তরল বর্জ্য-সহ নানাবিধ দূষণকারী বস্তু গ্রহণ করতে হচ্ছে, সে বিষয়ে প্রশাসকরা আশ্চর্য নীরব। পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গার বর্তমান ছবিটিও সেই সাক্ষ্য দেয়। সেখানে দূষণ শুধুমাত্র ঘাটগুলিতে সীমাবদ্ধ নেই, কলকাতা এবং হাওড়া, উভয় শহরের গঙ্গাতীর লাগোয়া বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি পরিবেশবিদরা গঙ্গার বিভিন্ন ঘাট ও তীর ঘুরে যে ভয়াবহ অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা পরিবেশ আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু, এ-যাবৎ কাল গঙ্গা নিয়ে প্রতিশ্রুতি এবং বাস্তবচিত্রের মধ্যে যে আলোকবর্ষের ব্যবধান, তাতে বিশেষ আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। পরিবেশ আদালত নির্দেশ দেবে, প্রশাসকরা তাকে অগ্রাহ্য করে নিজ মতে, ইচ্ছায় চলবেন— এমন ধারাই প্রবহমান। সেই ধারা অক্ষুণ্ণ রেখে গত মাসে রাজ্যের মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে হওয়া বৈঠকে কলকাতা এবং সংলগ্ন এলাকার গঙ্গাতীর প্লাস্টিক এবং অন্য কঠিন বর্জ্য মুক্ত রাখার আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তব প্রতিফলন এখনও অ-দৃশ্য।
প্রায় বছর দুয়েক আগে জাতীয় পরিবেশ আদালত কলকাতার গঙ্গা এবং সংলগ্ন ঘাটের দূষণ রোধ, ঘাট সংরক্ষণের মতো বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা জানানোর জন্য রাজ্য সরকারকে কঠোর নির্দেশ দেয়। কেন্দ্র এবং রাজ্যের প্রতিনিধিদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় কমিটিও। তা সত্ত্বেও নদীর দুই পাড়কে আবর্জনা ফেলার জায়গায় পরিণত করা হয়েছে। তারও পূর্বে একটি মামলায় জাতীয় পরিবেশ আদালত গঙ্গাতীর সংলগ্ন পুরসভাগুলিকে নির্দেশ দিয়েছিল, তরল বর্জ্য সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট-এর মাধ্যমে পরিশোধন করে গঙ্গায় ফেলতে। সেই কাজও গতি পায়নি। বরং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পদক্ষেপ না করেই গঙ্গায় অশোধিত বর্জ্য ফেলার কুঅভ্যাসটি এখনও বজায় আছে। আবার, হাওড়ার চাঁদমারি ঘাট সংলগ্ন ন’টি হোটেলের বিরুদ্ধে দূষণ ছড়ানোর অভিযোগ ওঠায় ২০০৭ সালে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সেগুলিকে স্থানান্তরের নির্দেশ দিলেও আজও সেগুলি স্ব-স্থানে রয়ে দিয়েছে। গঙ্গার মতো গুরুত্বপূর্ণ নদীর ক্ষেত্রে প্রশাসনিক উদাসীনতার এগুলি যৎসামান্য নমুনা।
অথচ, গঙ্গার শুদ্ধতা বজায় রাখতে ঢাকঢোল কম পেটানো হয়নি। আশির দশকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর উদ্যোগে গৃহীত হয়েছিল গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান। উদ্দেশ্য, নদীর দূষণভার কমানো। কিন্তু ৪০০০ কোটি টাকার অধিক ব্যয়ের পরেও সেই প্রকল্প শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ। অতঃপর ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে সূচনা হয় ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পের। বরাদ্দ হয় ২০,০০০ কোটি। তা সত্ত্বেও গঙ্গার দুরবস্থা অব্যাহত। কখনও রাজ্য অভিযোগ তুলেছে অপ্রতুল কেন্দ্রীয় বরাদ্দের, কখনও অভিযোগ, টাকা পেয়েও কাজে গতি না আসার। অথচ, গঙ্গার উপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বিচার করলে এই নদীকে শুদ্ধ রাখা যে আবশ্যক, তা সহজবোধ্য। তবুও নদীকে ঘিরে রাজনৈতিক দূষণ কমে না। শুধু আইনি লড়াই এবং কেন্দ্র-রাজ্য চাপানউতোরে যে ভারতের প্রধানতম নদীটি বাঁচবে না, সেই সত্য স্বীকারের এ বার সময় এসেছে।