WB Panchayat Election 2023

নজিরবিহীন

সাদা থানের প্রত্যাবর্তনই প্রমাণ, তৃণমূল কংগ্রেস তার পূর্বসূরি সিপিএমের থেকে রিলে রেসের বেটনটি নির্ভুল তৎপরতায় ও অকৃত্রিম আগ্রহে হাতে তুলে নিয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০২৩ ০৬:২০
Share:

বিরোধী প্রার্থীর বাড়িতে পৌঁছেছে সাদা থান, সঙ্গে রজনীগন্ধা ফুল, মিষ্টি। বার্তাটি স্পষ্ট: ভোট থেকে সরে না দাঁড়ালে জীবনসংশয় অনিবার্য। —ফাইল চিত্র।

ইতিহাসের পুনরাবর্তন যে জগৎসংসারের অমোঘ নিয়ম, ২০২৩-এর পঞ্চায়েত ভোটের পশ্চিমবঙ্গ তা মর্মে মর্মে বুঝছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হুগলির পর এ বার পূর্ব মেদিনীপুরে বিরোধী প্রার্থীর বাড়িতে পৌঁছেছে সাদা থান, সঙ্গে রজনীগন্ধা ফুল, মিষ্টি। বার্তাটি স্পষ্ট: ভোট থেকে সরে না দাঁড়ালে জীবনসংশয় অনিবার্য। এ জিনিস বাম আমলে পঞ্চায়েত ভোটে শুধু যে হত তা-ই নয়, এক প্রকার নিয়মে পর্যবসিত হয়েছিল, এ কথা বঙ্গবাসীর পক্ষে ভুলে যাওয়া শুধু কঠিন নয়, নিতান্ত অসম্ভব। এখন যারা শাসক দল সেই তৃণমূলের নেতা ও কর্মীরা তা নিয়ে প্রতিবাদে মুখর হতেন, ঠিক যেমন এখন হচ্ছেন বিরোধী সিপিএম ও বিজেপির নেতা ও কর্মীরা। মতাদর্শের মিল থাকলে তবু ঐতিহ্য বা পরম্পরা বয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নটি আসে— সিপিএম বা বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের আদর্শের বিন্দুবৎ মিলও কেউ খুঁজে পাবেন না। কিমাশ্চর্যম্‌, তা সত্ত্বেও একটি ‘ঐতিহ্য’ধারা বেগবতী: পঞ্চায়েত ভোটে হিংসার ‘ঐতিহ্য’। সাদা থানের প্রত্যাবর্তনই প্রমাণ, তৃণমূল কংগ্রেস তার পূর্বসূরি সিপিএমের থেকে রিলে রেসের বেটনটি নির্ভুল তৎপরতায় ও অকৃত্রিম আগ্রহে হাতে তুলে নিয়েছে।

Advertisement

যে যায় লঙ্কায় সে-ই হয় রাবণ— লোকপ্রবাদের এই নিয়তিবাদেও সব সাঙ্গ হলে তবু কথা ছিল। কিন্তু আজকের পশ্চিমবঙ্গবাসী দেখছেন আরও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি: পূর্বসূরির থেকে ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রবণতাটি নিয়ে, রোজকার কথায় ও কাজে শুধু তা অভ্যাস করাই নয়, দায়িত্ব-সহকারে তাকে চরম সীমায় নিয়ে যাওয়ার কাজটিও করে চলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। পঞ্চায়েত ভোটে হিংসা তার নানা উত্তরাধিকারের একটি মাত্র: বাম আমলে বিরোধীদের নিরস্ত করতে যে যে পন্থা নেওয়া হয়েছিল, তার প্রতিটির ব্যবহার এই জমানাতেও দেখা যাচ্ছে, তফাত শুধু মাত্রার, বা বলা ভাল মাত্রাহীনতার। হাই কোর্ট রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে চরমতম ভর্ৎসনা করছে, বিরোধী প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বিকৃতির অভিযোগে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিচ্ছে বিডিও-র বিরুদ্ধে, খাস রাজভবনে কনট্রোল রুম খুলছেন রাজ্যপাল— পশ্চিমবঙ্গে এ জিনিস আগে দেখা যায়নি, এ বার শাসক দলের দৌলতে যা দেখা গেল। পঞ্চায়েত ভোটে হিংসা নতুন নয়, কিন্তু গ্রামবাংলা দখলে আনতে শাসক দলের এই বেপরোয়া রাখঢাকহীন নির্লজ্জতা এ রাজ্য এত কাল দেখেনি।

পশ্চিমবঙ্গের শাসন-ইতিহাসে এই নীতিবিবর্জিত অনাচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন তৃণমূল কংগ্রেসের নিজস্ব অবদান। এ-ও মনে রাখতে হবে, এই মুহূর্তে রাজ্যের জেলায় জেলায় শাসক দলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতে যা যা হচ্ছে তা সামগ্রিক অপশাসনের খণ্ডাংশ মাত্র। নাগরিক-জীবনের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলিকেও এই অপশাসন গ্রাস করেছে। তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে প্রতি পদে— স্কুলশিক্ষায় শিক্ষক নিয়োগের অতলস্পর্শী দুর্নীতিতে, নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর মুখে কলেজশিক্ষার বহুবিধ অব্যবস্থায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্য বাছাই ও নিয়োগ নিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে দৃষ্টিকটু টানাপড়েনে। বাম আমলেও শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ ছিল— ‘অনিলায়ন’ শব্দটি জনস্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার নয়— তবে আজকের মতো তার শিকড় এত গভীরে চারিয়ে যায়নি, মন্ত্রী থেকে অভিনেত্রী, শিক্ষা সংস্থার আধিকারিক থেকে ছাত্রনেতা হয়ে শাসক দলের অতিসাধারণ কর্মী পর্যন্ত তার জাল ছড়ায়নি। এ রাজ্যে আজ কোনও নতুন ও বৃহৎ শিল্পোদ্যোগ নেই, কর্মসংস্থানের প্রশ্ন তুললেও কোনও উত্তর নেই, আছে কেবল উৎসবের তালিকা আর ছুটির নির্ঘণ্ট, ‘কেন্দ্রের বঞ্চনা’র খতিয়ান এবং তৎসত্ত্বেও নাগরিককে ভূরি ভূরি সরকারি পরিষেবা ‘পাইয়ে দেওয়া’র আস্ফালন। এই সামগ্রিক আচরণে মিশে আছে এমন এক দম্ভ যা গণতান্ত্রিক নিয়মনীতির তো বটেই, নাগরিকের অসন্তোষেরও ধার ধারে না। শাসকের অভব্যতার এই পরাকাষ্ঠা বাস্তবিকই নজিরবিহীন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement