যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। —ফাইল চিত্র।
অভিধান অনুসারে সমাবর্তন শব্দটির অর্থ: বেদ অধ্যয়নের পরে শিষ্যের গুরুগৃহ থেকে গার্হস্থজীবনে প্রত্যাবর্তন, এবং সেই উপলক্ষে বিহিত ক্রিয়াকর্মের অনুষ্ঠান। অর্থটি প্রাচীন। যুগ বদলেছে, বদলেছে শিক্ষার চেহারা এবং চরিত্র। কিন্তু ওই আদি অর্থ আজও জানিয়ে দেয়— বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানটির মর্যাদা কতখানি। এ-কথা শুনে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল উভয়েই সম্ভবত পরম ঔদাসীন্য সহকারে বলবেন: ও-সব প্রাচীন অভিধান দিয়ে আজকের বিশ্ববিদ্যালয় চলে না। তা হলে কী দিয়ে চলে? চলে রাজনীতি দিয়ে। ক্ষুদ্র, সঙ্কীর্ণ, নৈতিকতারহিত, বিবেকবর্জিত ক্ষমতাসর্বস্ব রাজনীতি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে তারই এক উৎকট রূপ দেখা গেল। একটি প্রথম সারির সম্মানিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সমাবর্তনের মতো মর্যাদাময় অনুষ্ঠান যে ভাবে দুই তরফের মল্লযুদ্ধের শিকার হল, যে কোনও সুচেতন নাগরিক তা দেখে নিঃসন্দেহে শিহরিত হয়েছেন।
ক’জন বিস্মিত হয়েছেন, সে-কথা অবশ্য বলা শক্ত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা সাম্প্রতিক, কিন্তু একেবারে নতুন বা বিচ্ছিন্ন নয়। এ-রাজ্যের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরটি ক্ষমতামত্ত কর্তাব্যক্তিদের শক্তিপরীক্ষার রণভূমিতে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজভবন বনাম বিকাশ ভবন/নবান্ন দ্বৈরথে অধুনা প্রধান প্রকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে উপাচার্যের পদটি। মান্ধাতা আমলের ‘ঐতিহ্য’ বহন করে আজও রাজ্যপাল রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত কর্ণধার উপাচার্য, অন্তর্বর্তী হলেও— তাঁর সঙ্গে আচার্যের সুস্থ, স্বাভাবিক এবং সসম্মান সম্পর্ক ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান চলবে, রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কোনও প্রভাব সেই সম্পর্কের উপর পড়বে না, একই ব্যক্তি রাজ্যপাল এবং আচার্যের আসনে দু’টি স্বতন্ত্র সত্তা হিসাবে কাজ করবেন, সরকারি কর্তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ করবেন না— এই প্রাথমিক শর্তগুলি অনেক দিন ধরেই নানা ভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলি সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়ে দুই পক্ষের সমন্বয়ের বদলে এই লাগাতার সংঘাত কার্যত অভূতপূর্ব।
যাদবপুরে সেই সংঘাতের যে নতুন অধ্যায় শুরু হল, তার প্রাথমিক দায় রাজ্যপালের উপর বর্তায়। পূর্বনির্ধারিত একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের এক দিন আগে অন্তর্বর্তী উপাচার্যকে সরিয়ে দিয়ে তিনি যে বিপুল বিভ্রাট বাধিয়েছেন, তা যে কোনও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন আধিকারিকের আচরণেই অকল্পনীয়। অ-স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অ-স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই উপাচার্যকে তিনিই নিয়োগ করেছিলেন। আজ যদি কোনও কারণে সেই ব্যক্তি সম্পর্কে তিনি বিরূপ হয়ে থাকেন, এমন যথেচ্ছাচারের মধ্য দিয়ে সেই বিরূপতার প্রকাশ ঘটাতে হবে! রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপে যে ভাবে সেই অন্তর্বর্তী উপাচার্যকে মঞ্চে বসিয়ে সমাবর্তন উৎসব হয়েছে, রাজ্যপাল হয়তো অতঃপর তার বিরুদ্ধে আদালতে যাবেন। আদালতের বিচার আদালত করবে। আচার্য হিসাবে তাঁর আইনি অধিকার কত দূর যায়, সামগ্রিক ভাবেই সেই জটিল প্রশ্নের নিষ্পত্তি হওয়াও জরুরি। কিন্তু সমাবর্তন নিয়ে এই বিশৃঙ্খলার ফলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসম্মানের কথা ছেড়েই দেওয়া গেল, ছাত্রছাত্রীরা যে অনিশ্চয়তার শিকার হয়েছেন, তার দায় কে নেবে? এখানেই রাজ্য সরকারের গুরুদায়িত্ব। রাজ্যপালের সঙ্গে তাঁদের দ্বন্দ্বযুদ্ধ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাঁচানোর দায়িত্ব। ক্ষুদ্র রাজনীতি এবং সঙ্কীর্ণ অহঙ্কার ছেড়ে শিক্ষামন্ত্রী তথা তাঁর মাথার উপরে থাকা মুখ্যমন্ত্রী অবিলম্বে এই ভয়াবহ ও লজ্জাকর সঙ্কটের সুরাহা করুন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় উপলক্ষমাত্র, পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটির মানমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হতে দেবেন না। লড়াই-মত্ত দুই তরফেরই সেই মর্যাদাবোধ আছে কি না, তা নিয়ে অবশ্য গভীর সংশয় আছে।