রাজনাথ সিংহ। —ফাইল চিত্র।
সেনা সামলানো কঠিন কাজ। কিন্তু রাজনীতি, বিশেষত ভোট আরও বড় বালাই— রাজনাথ সিংহ নিশ্চয়ই হাড়ে-হাড়ে বুঝছেন। জঙ্গি হানা, সেনার জঙ্গি দমন অভিযান এবং এই দুইয়ের মধ্যে পড়ে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি জম্মু ও কাশ্মীর দেখে আসছে সেই নব্বইয়ের দশক থেকে। যা দেখেনি তা হল কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী তথা সরকারের তটস্থ তৎপরতা। গত ২১ ডিসেম্বর পুঞ্চে সেনাদের উপর জঙ্গি হানায় চার জন সেনার মৃত্যু হয়, সেনা অভিযান ও তল্লাশির সূত্রে স্থানীয় গ্রাম থেকে কয়েক জন গ্রামবাসীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরে জানা যায়, সেনা হেফাজতে নির্যাতনে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। শুরু হয় স্থানীয় মানুষদের বিক্ষোভ, এমনই যে ঘটনার চার দিনের মধ্যে সেখানে পৌঁছে যান প্রতিরক্ষামন্ত্রী— লেফটেন্যান্ট গভর্নর ও সেনাপ্রধানকে সঙ্গে নিয়ে। আশ্বাস দেন, ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত ও দ্রুত ‘বিচার’ হবে, হবে ক্ষতিপূরণ ও সরকারি চাকরির ব্যবস্থাও। সেনার সংশ্লিষ্ট বাহিনীর কম্যান্ডার-সহ তিন আধিকারিককে এরই মধ্যে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে; এমনকি সূত্রের খবর, খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যোগাযোগ করেছেন জম্মু ও কাশ্মীর প্রশাসনকে, ৩০২ ধারায় এফআইআর দায়ের করেছে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ।
কেন্দ্রের নড়েচড়ে বসা, মৃতদের পরিবারবর্গের কাছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর প্রায় ‘ভুল স্বীকার’-এর মতো আচরণ দেখে ধন্দ জাগে, এ কি সত্য? সত্য, তবে স্বার্থহীন নয়। মৃত গ্রামবাসীরা গুজ্জর-বকরওয়াল গোষ্ঠীর মানুষ— কাশ্মীরের প্রত্যন্ত ও অরণ্যপর্বতসঙ্কুল পরিবেশে, নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর এক বিরাট অংশে যাঁদের অনায়াস যাতায়াত যাযাবরবৃত্তির সূত্রে। এই গোষ্ঠীচরিত্রই দীর্ঘ কাল ধরে তাঁদের করে তুলেছে ভারতীয় সেনার সহায়ক: কোন জায়গা দিয়ে জঙ্গি ঢুকে পড়ছে, কোন গ্রামে কোন সন্দেহভাজনকে দেখা যাচ্ছে, এ-হেন তৃণমূল স্তরের গুপ্তচরবৃত্তি ও তথ্য সরবরাহে এঁদের বিকল্প নেই— সেনা ও সরকারও তা বিলক্ষণ জানে। কয়েক দশক ধরে যাঁরা হয়ে উঠেছেন সেনাবাহিনীর ‘চোখ ও কান’, সেনা হেফাজতে তাঁদেরই বেঘোরে প্রাণ গেলে আখেরে সরকারের বিরাট ক্ষতি, কারণ এর সঙ্গে দেশের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িয়ে। অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা আধিকারিক আঙুল তুলেছেন, ২০১১-য় পুঞ্চ ও রাজৌরিকে জঙ্গিমুক্ত ঘোষণার পর থেকে গত বারো বছরে এই অঞ্চলে ভারতীয় সেনা ও গুজ্জরদের মধ্যে যোগাযোগ আলগা হয়েছে, অবিলম্বে এই ‘স্থানীয় সংযোগ’ পাকাপোক্ত করা দরকার।
শুধুই কি জাতীয় নিরাপত্তা? কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন সরকারের এ-ও ভাল করেই জানা, জম্মু ও কাশ্মীরের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ হলেন এই গুজ্জর গোষ্ঠীর মানুষেরা। নতুন বছর শুরু হয়েছে, লোকসভা নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়ল বলে। কেন্দ্রশাসিত জম্মু ও কাশ্মীরে বিজেপির ভোট-ভাঁড়ার ভরাতে গুজ্জরদের ভোট অবশ্যই কাজে দেবে। এই সময় সেনাবাহিনীর বেচালে গুজ্জররা সরকারের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলে শাসক দলের জন্য তার ফল মোটেই সুখের হবে না। সেনার সূত্রে বিজেপি সরকার যে বিপাকে পড়ল তা থেকে উদ্ধার পেতেই এত সক্রিয়তা, প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দৌড়ে যাওয়া, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্বিগ্ন নির্দেশ। দেশের নিরাপত্তা বিকল্পহীন ভাবে জরুরি, তবে নির্বাচনমুখী বছরে গুজ্জরদের মানভঞ্জনও বিজেপির কাছে যারপরনাই জরুরি, সন্দেহ নেই।