সরকারি সমীক্ষাতেই ধরা পড়েছে, শিশুদের লিখতে-পড়তে পারার, অঙ্ক কষতে পারার দক্ষতা কমে গিয়েছে। প্রতীকী ছবি।
কেন্দ্রীয় সরকারের স্কুল পিছু প্রতি বছর যা খরচ হয়, তার চাইতে বেশি খরচ হয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘পরীক্ষা পে চর্চা’ অনুষ্ঠানের আয়োজনে। উপরন্তু, গত তিন বছর স্কুলের বরাদ্দ রয়েছে একই, অনুষ্ঠানের খরচ উত্তরোত্তর বেড়েছে। সংসদে প্রদত্ত এই তথ্য স্কুলশিক্ষার বাজেটের মূল কথাটিও দেখিয়ে দেয়। তা হল, যে উদ্যোগগুলি প্রধানমন্ত্রীর ‘শিক্ষাবন্ধু’ ভাবমূর্তির সহায়ক, সেগুলোর প্রতি সরকার উপুড় হস্ত। যেমন, ‘প্রাইম মিনিস্টার স্কুলস ফর রাইজ়িং ইন্ডিয়া’ (পিএম-শ্রী) নামাঙ্কিত প্রকল্পে আট হাজার স্কুল তৈরির ঘোষণা। এই খাতে চার হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। অথচ, কেন্দ্রীয় সরকারের স্কুল-পিছু বার্ষিক বরাদ্দ থমকে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকায়। রাজ্য সরকার এবং পুরসভা-পঞ্চায়েত স্কুলগুলির দৈন্যদশা এমনই যে, দরিদ্র পরিবারও ঝুঁকছে বেসরকারি স্কুলের দিকে, বাড়ছে স্কুলছুট শিশুও। কোভিড অতিমারি স্কুল শিক্ষাকে বিপর্যস্ত করেছে। সরকারি সমীক্ষাতেই ধরা পড়েছে, শিশুদের লিখতে-পড়তে পারার, অঙ্ক কষতে পারার দক্ষতা কমে গিয়েছে। শিশুদের নিয়মিত পঠনপাঠনে ফেরাতে, তাদের দক্ষতা শ্রেণি-উপযোগী মানে উন্নীত করতে সরকারের হাতে যা প্রধান প্রকল্প, সেই ‘সমগ্র শিক্ষা মিশন’-এ বরাদ্দ প্রায় কিছুই বাড়েনি আগামী অর্থবর্ষে। যা বুনিয়াদি শিক্ষার প্রতি কেন্দ্রের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য। শিক্ষাক্ষেত্রে কতকগুলি উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের সূচনা হলেও, তা সামগ্রিক চিত্রের ধূসরতা সরাতে পারবে কি না, সে উদ্বেগ থেকেই যায়।
এক দিকে আড়ম্বরপূর্ণ ঘোষণা, অন্য দিকে মৌলিক লক্ষ্যের প্রতি উপেক্ষা— এই বৈপরীত্য কেন্দ্রের বাজেটের মজ্জাগত। যেমন, প্রধানত জনজাতি এলাকাগুলিতে অবস্থিত একলব্য মডেল আবাসিক স্কুলগুলিতে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগের জন্য আগামী অর্থবর্ষে প্রায় ছ’হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। অথচ, জনজাতির প্রি-ম্যাট্রিক পড়ুয়াদের জন্য বৃত্তির পরিমাণ ৪১৯ কোটি টাকা (২০২২-২৩) থেকে কমে হয়েছে ৪১২ কোটি (২০২৩-২৪)। ওই ৭ কোটি টাকার অর্থমূল্য সরকারের কাছে কতখানি, বলা কঠিন। কিন্তু তার প্রতীকী মূল্য খুব কম নয়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলির জন্য প্রি-ম্যাট্রিক বৃত্তি কেন্দ্র সীমিত করেছে নবম-দশম শ্রেণিতে। অথচ, মুসলিম, তফসিলি জাতি ও জনজাতির শিশুরা প্রাথমিক ও উচ্চ-প্রাথমিক স্তরেও স্কুল ছাড়ছে, বলছে সরকারি তথ্যই। বুনিয়াদি শিক্ষার লক্ষ্য প্রতিটি শিশুকে স্কুলে আনা, শিশুর শিক্ষা ও পুষ্টির অধিকারের সুরক্ষা। কেন্দ্র-পরিচালিত কিছু আদর্শ স্কুলে কী করে সেই সার্বিক প্রয়োজন মিটবে, কী করে অতীতের ব্যর্থতা পূরণ হবে?
অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের উত্তর— জাতীয় ডিজিটাল লাইব্রেরি তৈরি হবে। ডিজিটাল বিভাজন স্কুল শিক্ষায় যে দূরত্ব তৈরি করেছিল (৪৩ শতাংশ গ্রামীণ শিশু অনলাইন ক্লাসের নাগাল পায়নি) তাতে প্রশ্ন জাগে, ডিজিটাল বই কী করে পড়বে শিশুরা? ডিজিটাল সংযোগকে স্কুল-পরিকাঠামোর অন্তর্গত করাই অতিমারি-উত্তর সরকারি নীতি হওয়ার কথা ছিল। সেখানে রাজ্যগুলিকে পঞ্চায়েত বা ওয়ার্ড স্তরে ডিজিটাল পরিকাঠামো-যুক্ত লাইব্রেরি তৈরিতে উৎসাহ দানেই থেমেছেন অর্থমন্ত্রী। এ জন্য আগামী অর্থবর্ষে কোনও বরাদ্দের সন্ধানও মেলে না তাঁর বাজেটে। বরং দেখা যায়, ২০১৬ সালে সূচিত ‘জাতীয় ডিজিটাল লাইব্রেরি’ প্রকল্পে বরাদ্দ পাঁচ কোটি টাকা থেকে বেড়ে কুড়ি কোটি টাকায় পৌঁছেছে। টাকার অভাবে যেখানে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য গ্রন্থাগারিক পদে নিয়োগই বন্ধ করেছে, সেখানে শিশুদের কাছে ডিজিটাল বই পৌঁছনোর এই পরিকল্পনাকে বদ রসিকতা বলে মনে করতে পারেন অভিভাবকরা। কী করে শিশুরা বঞ্চনার চৌকাঠ অতিক্রম করে পৌঁছবে শিক্ষার প্রাঙ্গণে, সে প্রশ্ন রয়েই গেল।