মুম্বইতে বিরোধী বৈঠক। ছবি: পিটিআই।
পটনায় ২৩ জুন জন্মগ্রহণ এবং ১৮ জুলাই বেঙ্গালুরুতে নামকরণের পরে মুম্বইতে ৩১ অগস্ট ও ১ সেপ্টেম্বর দু’দিনের তৃতীয় সম্মেলনে বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নতুন মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’ কী পদক্ষেপ করে, সেই বিষয়ে নানা মহলে নানা ধরনের কৌতূহল ছিল। তবে সবচেয়ে বেশি কৌতূহল নিশ্চয়ই মাননীয় নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর সতীর্থদের। নিছক কৌতূহল নয়, উদ্বেগ। তাঁরা নির্বোধ নন, অতএব এই দু’মাসের ঘটনাপ্রবাহ অবলোকন করে হয়তো বুঝতে পেরেছেন যে, বিরোধী রাজনীতির এই প্রতিস্পর্ধী সংগঠনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা ব্যঙ্গবিদ্রুপের সস্তা কৌশলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না, এমনকি তড়িঘড়ি ‘এক দেশ এক ভোট’ বা সংসদের ‘বিশেষ অধিবেশন’ গোছের শিরোনাম উৎপাদন করেও প্রচারমাধ্যম তথা সামাজিক পরিসর থেকে বিরোধীদের সরিয়ে দেওয়া কঠিন হতে পারে। শাসকের উদ্বেগ এবং অস্থিরতাই প্রমাণ করে, ‘ইন্ডিয়া’ তার প্রাথমিক কাজে সফল। এই সাফল্য মূল্যবান, কারণ কার্যকর বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিই সার্থক গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান, এক অর্থে প্রধানতম, শর্ত। বিশেষত, আধিপত্যবাদী সংখ্যাগুরুবাদের দাপটে পর্যুদস্ত বর্তমান ভারতে।
অতঃপর? বিরোধীদের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে দু’টি বিষয়ে কিছু সঙ্কেত মুম্বইতে মিলেছে। এক, জনসংযোগ; দুই, আসন বণ্টন। ভারত জুড়ে মানুষের কাছে ইন্ডিয়া-র বার্তা পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সম্মেলনে গৃহীত হয়েছে দু’টি প্রস্তাব: এক দিকে সর্বত্র যথাসম্ভব সভা সমাবেশ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের আয়োজন, অন্য দিকে শরিক দলগুলির রাজনৈতিক বার্তার মধ্যে সমন্বয় রেখে চলার বন্দোবস্ত। অবশ্যই সুপ্রস্তাব। ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রচারের গুরুত্ব গত এক দশকে নরেন্দ্র মোদীর দৌলতে অকল্পিতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে। এই বাস্তবকে অস্বীকার করে গণতান্ত্রিক প্রতিস্পর্ধা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। নিজেদের বার্তাকে প্রচারের পরিসরে প্রবল ভাবে হাজির করা বিরোধী রাজনীতির এক বড় কাজ। রথী-মহারথীদের নিয়ে গঠিত সমন্বয় কমিটি সেই কাজের জন্য জরুরি, কিন্তু যথেষ্ট নয়। কাজটা করতে হবে বাস্তবের কঠিন জমিতে, নিরন্তর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে, যে পরিশ্রম প্রকৃত জনসংযোগের আবশ্যিক শর্ত। দ্বিতীয় বিষয়টি হল আসন সংক্রান্ত বোঝাপড়া। এই প্রশ্নে বাধাবিপত্তি বিস্তর, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ বা কেরলের মতো রাজ্যে ইন্ডিয়া-র শরিকরা পরস্পরের প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী, যে দ্বন্দ্ব কোনও ‘সর্বভারতীয়’ স্বার্থেই অস্বীকার করা বা সরিয়ে রাখা সম্ভব নয়। লক্ষণীয়, এই বাস্তবকে স্বীকার করে নিয়েই জোটের প্রস্তাবে ‘যত দূর সম্ভব’ এক সঙ্গে লড়াই করার কথা বলা হয়েছে। রাজনীতি সম্ভাব্যতার শিল্প, বিরোধীদের সামনে এখন সেই শিল্প নির্মাণের এক বড় পরীক্ষা। অগ্নিপরীক্ষা বললে অত্যুক্তি হয় না।
সেই পরীক্ষার কঠিনতম প্রশ্ন: বিরোধীরা জনসাধারণের সামনে শাসকের কোন বিকল্প পেশ করতে চান? সংখ্যাগুরুতন্ত্র তথা হিন্দুরাষ্ট্রের বিপ্রতীপে কোন ভারত তাঁদের কাঙ্ক্ষিত? এ-যাবৎ যে উত্তর বিরোধীদের বয়ানে শোনা গিয়েছে তার নাম: উদার, বহুমাত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, নাগরিকের অধিকারের প্রতি দায়বদ্ধ গণতান্ত্রিক ভারত। এই লক্ষ্য অবশ্যই যথাযথ। কেন্দ্রীয় শাসকরা প্রতিটি বিষয়ে তার বিপরীতে হাঁটছেন, সে কথাও অনস্বীকার্য। কিন্তু বিরোধী দলগুলিকেও আপন নীতি এবং আচরণে এই শর্তগুলি পূরণ করতে হবে, তা না হলে জনসাধারণের কাছে তারা যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারবে না। গণতান্ত্রিক আদর্শ ও আচরণবিধির প্রশ্নে বিরোধী শিবিরের বিভিন্ন নায়কনায়িকা ও তাঁদের অনুগামীদের এই বিশ্বাসযোগ্যতার অভাবই হিন্দুত্ববাদী শিবিরকে তাদের ভারত দখলের অভিযানে প্রভূত শক্তি জুগিয়েছে। আজ যদি বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতে হয়, তবে তার এক এবং একমাত্র ভিত্তি হতে পারে গণতন্ত্র। বিরোধীদের সেই গণতান্ত্রিকতার প্রমাণ দিতে হবে। কথায় নয়, কাজে।