এ রাজ্যে ‘আলোচনা’ রহিয়াছে কেবল শব্দকোষে, কর্মক্ষেত্রে তাহার স্থান নাই। দুই মাসের অধিক সময় আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যে অচলাবস্থা চলিতেছে, তাহা দেখিয়া তেমন সন্দেহ জাগিতে বাধ্য। ছাত্র সংসদের নির্বাচন, হস্টেল মেরামত, হাউসস্টাফ নির্বাচন— কোন বিষয়টির মীমাংসা পরস্পর কথোপকথন দ্বারা না হইতে পারে? কেন কলেজ ও হাসপাতালের নিয়মিত কাজ ব্যাহত করিয়া আন্দোলন করিতে হইবে? কেনই বা অনশনে বসিয়া ছাত্রেরা আপন শরীর ও স্বাস্থ্য ভঙ্গ করিবে? ছাত্রছাত্রীরা যদি আলোচনার দ্বারা মীমাংসার সম্ভাবনাকে খারিজ করিয়া দেন, তাহা হইলে শঙ্কিত হইতে হয়। পঠনপাঠনের বিষয় যাহাই হউক, কিছু মূল্যবোধ ও কুশলতা তৈরি করিয়া দেয় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাহার অন্যতম হইল আলোচনার দ্বারা বিরোধের সমাধান। আপন বক্তব্য প্রকাশ করিবার ক্ষমতা, অপরের বক্তব্য শুনিবার ইচ্ছা, এবং উভয়ের ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য মীমাংসায় পৌঁছাইবার আগ্রহ— ছাত্রদের এই পদ্ধতির উপযুক্ত করিয়া তোলে শিক্ষা। ইহাই গণতন্ত্রের রীতি, যাহা সংঘাতকে সহযোগিতায় রূপান্তরিত করে, যাহা ভিন্ন মতের সহাবস্থানকে সম্ভব, এমনকি স্বাভাবিক করিয়া তোলে। দুর্ভাগ্য, এই রাজ্যের কলেজগুলি শিক্ষার সেই আদর্শ হইতে যেন বহু দূরে সরিয়া গিয়াছে। ছাত্রছাত্রীরা ও তরুণ ডাক্তাররা বার বার আপন দাবি আদায়ে ধর্মঘটকেই বাছিয়াছেন। রোগীর দুর্ভোগকে দাবি আদায়ের অস্ত্র করিবার মানসিকতা কি ডাক্তারি ছাত্রদের থাকিতে পারে? সেই সম্ভাবনার কথা ভাবাও পীড়াদায়ক।
তেমনই পীড়িত করে এই সংবাদ যে, আন্দোলনরত ছাত্রদের নিবৃত্ত করিতে কলেজ অধ্যক্ষ তাহাদের বাড়িতে পুলিশ পাঠাইয়াছেন। বাবা-মায়ের উপর চাপ সৃষ্টি করিয়া ছাত্রদের বশীভূত করিবার কথা ভাবিয়াছেন। ছাত্র-আন্দোলন এই রাজ্যে নূতন নহে। তাহার মধ্যে বিশৃঙ্খলা, সীমালঙ্ঘনের দিকটি যেমন রহিয়াছে, তেমনই স্বৈরাচার ও পীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্রশক্তির প্রতিবাদের সামাজিক মূল্যও রহিয়াছে। প্রতিবাদী ছাত্রদের ‘অপরাধী’ প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা অন্যায় কাজ। পুলিশি প্রহার অথবা কলেজ হইতে বহিষ্কারের ভীতিপ্রদর্শনও। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকিয়া যুক্তিযুক্ত, সহানুভূতিপূর্ণ আলোচনা করিবার কৌশলটি শিক্ষকদের দেখিয়াই ছাত্ররা রপ্ত করিয়া থাকে। এ ক্ষেত্রে অধ্যক্ষের পক্ষ লইয়া আলোচনায় আহ্বান করিয়াছে স্বাস্থ্য দফতর-নির্মিত কমিটি। ছাত্রদের কমিটিতে ভরসা নাই, অধ্যক্ষের দুর্ব্যবহার দর্শাইয়া তাঁহার পদত্যাগের দাবিতে তাহারা অনড়।
ইহাই প্রথম নহে। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্র অথবা শিক্ষকদের যে কোনও দাবি অথবা প্রতিবাদ অচিরে ‘শক্তির পরীক্ষা’ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। অবস্থান, অনশন, পুলিশি নিগ্রহের পথ ঘুরিয়া আসিতে হয়। আনুগত্যই স্বাভাবিক, প্রতিবাদের স্বর ঔদ্ধত্যের পরিচয়— এই মনোভাবের জন্যই কি আলোচনা অনাবশ্যক মনে হইতেছে? মেডিক্যাল কলেজগুলিতে সংঘাতের পশ্চাতেও রাজনৈতিক নেতাদের আধিপত্য বিস্তার এবং আনুগত্য আদায়ের চেষ্টা কাজ করিতেছে। স্বাতন্ত্র্য ও স্বশাসন যে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাণশক্তি। রাজনীতি তাহাকে ব্যাহত করিলে বার বার নানাবিধ সংঘাতে তাহার প্রকাশ ঘটিবে।