শিক্ষামন্ত্রী সওয়াল করেছেন, রাজ্য জুড়ে স্কুলপড়ুয়াদের নীলসাদা পোশাকে বিশ্ববাংলা ‘লোগো’ বা প্রতীকচিহ্ন জুড়ে দেওয়া হোক। হঠাৎ এমন সওয়াল শুনে বিস্ময়াবিষ্ট হওয়ার জোগাড়। ছাত্রছাত্রীরা কী ইউনিফর্ম পরে পড়াশোনা করতে যাবে, তাতে কী লোগো থাকবে, এ সবেও এ বার সরকার নাক গলাবে? সরকারের কি আর কোনও কাজ নেই? ইউনিফর্ম নির্ধারণের অধিকার কেবলমাত্র স্কুলেরই। কী জামা পরা হবে, স্কুলে কোন রুটিনে ক্লাস হবে, কোথায় বসা হবে, এগুলি যুগে যুগে স্কুলই ঠিক করে এসেছে, এ সব ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ মানে স্কুলের স্বাতন্ত্র্য, স্বাধিকারে আঘাত। গণতান্ত্রিক হিসাবে খ্যাতি নেই, তেমন দেশগুলিতেও এ-হেন ঔদ্ধত্যের নিদর্শন মেলা কঠিন— চিন বা রাশিয়াতেও নিশ্চয়ই সব স্কুলপড়ুয়াকে সরকার-নির্দিষ্ট পোশাক পরে স্কুলে যেতে হয় না। শিক্ষামন্ত্রী বিধানসভায় বলেছেন, এটা রাজনৈতিক বিষয় নয়। বস্তুত বিষয়টি আদ্যন্ত রাজনৈতিক। সকলে এক পোশাক পরতে বাধ্য, এই প্রথা আর যা-ই হোক, গণতান্ত্রিক নয়। স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে সেই রীতি প্রচলনের অর্থ, নাগরিক সমাজের পরিসর দখল করতে উদ্যত রাষ্ট্র। স্কুলের পোশাক-বিধি যে বার বার রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে আসে, তার কারণ পোশাক কিংবা প্রতীকে প্রতিফলিত হয় মতাদর্শ, রুচিবোধ। স্কুলের পোশাক-বিধিতে ভিন্নতার প্রতি সরকারের অসহিষ্ণুতার অর্থ, গণতন্ত্রের পরীক্ষায় সরকার ফেল। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, বিশ্ববাংলা ‘লোগো’ সরকারের প্রতীক। তাঁর এই ‘আশ্বাসবাণী’ সন্দেহ ও বিরক্তির উদ্রেক করে। সরকারের প্রতীক স্কুলপড়ুয়া বুকে ধারণ করবে কেন, শিশুরা কি সরকারের সম্পত্তি? সরকারের আদর্শ বা প্রকল্পের প্রচারের জন্য স্কুলপড়ুয়াদের ব্যবহার শিশুর বাক্স্বাধীনতার অধিকারের অবমাননা। স্কুল ইউনিফর্মে সরকারি লোগো বাধ্যতামূলক করলে তা ঐক্যের চেয়ে বৈষম্যকে বেশি স্পষ্ট করবে, কারণ বেসরকারি স্কুলপড়ুয়াদের শর্তমুক্তির সাক্ষ্য দেবে তাদের লোগোহীন ইউনিফর্ম। এই কি সাম্যের শিক্ষা?
শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, বিশ্ববাংলার প্রতীকচিহ্নে বাংলাকে বিশ্বস্তরে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন বিধৃত রয়েছে। উত্তম কথা। কিন্তু স্বপ্ন যত উৎকৃষ্টই হোক, একের স্বপ্ন অন্যের উপর চাপানো চলে না। বাংলা তথা ভারতে শিশুর পঠনপাঠনের দায় বহু দিন নাগরিক সমাজই বহন করেছে। নানা মতাদর্শে নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আপন দর্শন অনুসারে কোনও এক বাণী, কোনও প্রতীকী চিত্রকে নির্বাচন করেছে, যা স্কুলের নামের সঙ্গে শোভা পায়। এ ভাবে সৎ চিন্তা, সদাচারের নানা ধারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়ে সমাজকে সিঞ্চিত করে চলেছে। শত ফুল বিকশিত হয়েছে। আজ গণতন্ত্রের সেই বর্ণিল বাগিচা সরকারের চোখে আগাছা-জঞ্জাল। তাই সরকারি ধারণার সিমেন্ট দিয়ে শিক্ষার পরিসর বাঁধানো হচ্ছে। সব স্কুল-ভবনের এক রং, সব ছেলেমেয়ের জামাতেও সেই রং, এমনকি সকলের ‘স্বপ্ন’-ও হতে হবে এক! নীল-সাদা নাকি ‘শুভ’-র প্রতীক। এই নতুন পাঠের জন্য ধন্যবাদ দিয়েও মনে করাতে হচ্ছে ইতিহাসের পাঠ: সরকারি প্রতীক নাগরিককে বহন করতে বাধ্য করার ঘোর অশুভ ঘটনাক্রম।
তবে মন্ত্রী একটি শিক্ষামূলক বার্তা দিলেন। অন্য রাজ্যও এক ইউনিফর্ম রীতির প্রচলন করেছে, তার দৃষ্টান্ত দিতে উল্লেখ করেছেন উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত এবং অসমের। এই তিনটি রাজ্যে যে দলটি ক্ষমতাসীন, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারের শিক্ষাচিন্তা তাকেই অনুসরণ করছে— এই দাবির ভারটি বড়ই দুঃসহ। সে আদর্শে বিতর্কের স্থান নেই। অথচ, রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী, গান্ধী ও সুভাষচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র এবং মেঘনাদ সাহারা বাংলা তথা ভারতের আদর্শ রূপ নিয়ে যে তর্ক করেছিলেন, সেগুলিই এই দেশ, এই রাজ্যের ভিত্তি। মতবিরোধ থেকেই আহরণ করতে হয় গণতন্ত্রের পাঠ।