পশ্চিমবঙ্গে স্কুলকলেজ খুলিবার পালা কেন আরও আগে শুরু হয় নাই, সেই প্রশ্নটি থাকিয়াই গেল। কিন্তু এখন তাহা অপেক্ষা অনেক বড় প্রশ্ন— প্রথমত, ১৬ নভেম্বর হইতে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি স্কুলের নবম হইতে দ্বাদশ শ্রেণি অবধি লেখাপড়া কতটা সুষ্ঠু ভাবে চালু করা যাইবে এবং দ্বিতীয়ত, প্রাথমিক স্তর হইতে অষ্টম শ্রেণি অবধি স্কুল খুলিবার পর্বই বা কবে শুরু করা হইবে। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর স্পষ্টতই নির্ভর করিতেছে কোভিড সংক্রমণের গতিবিধির উপরে। সন্দেহ নাই, উচ্চতর শ্রেণির পঠনপাঠন শুরু করিবার কতটা প্রভাব সংক্রমণের উপরে পড়ে, তাহাও এই পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ— স্কুল অংশত খুলিবার পরেও যদি সংক্রমণের মাত্রা না বাড়ে তাহা হইলে অদূর ভবিষ্যতে স্কুল সম্পূর্ণ খুলিবার সম্ভাবনা বাড়িবে। অন্য দিকে, প্রথম পর্বের অভিজ্ঞতা হইতে সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য কী কী করণীয় সেই বিষয়েও কার্যকর ধারণা মিলিতে পারে, যাহাতে পরবর্তী পর্বে সতর্কতা আরও জোরদার করা যায়। অতিমারি সম্পূর্ণ নির্মূল করিয়া তবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিব— এমন ভাবনা অচল হইয়া গিয়াছে, তাহার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে রাখিয়াই ক্রমশ সমস্ত কাজকর্ম চালাইতে হইবে। ইতিমধ্যে জনজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাহাই চলিতেছে। শিক্ষাও সেই প্রত্যাবর্তনের বাহিরে থাকিতে পারে না।
এই কারণেই স্কুলগুলিতে নিরাপদে পঠনপাঠন চালাইবার প্রয়োজনীয় বন্দোবস্ত করিতে একশত শতাংশ উদ্যোগ ও তৎপরতা জরুরি। উদ্বেগের কারণ ইহাই যে, রাজ্যের সর্বত্র সেই আয়োজন পূর্ণোদ্যমে চলিবার ভরসা মিলিতেছে না। অনেক এলাকাতে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই প্রস্তুতির ঘাটতি আছে। ঘাটতি অর্থের, ঘাটতি লোকবলের, ঘাটতি উৎসাহ এবং দায়িত্ববোধেরও। এখানেই বিভিন্ন স্তরের প্রশাসন তথা জনপ্রতিনিধিদের বিশেষ দায়িত্ব। প্রচলিত গয়ংগচ্ছ ভঙ্গিতে কাজ করিবার সময় ইহা নহে, আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় স্কুলগুলিকে প্রস্তুত করিয়া তোলা দরকার, সে জন্য প্রয়োজনে বিশেষ সাহায্যের বন্দোবস্ত করিবার কাজটি সরকারকেই করিতে হইবে। গত দেড় বৎসর ধরিয়া প্রশাসক ও জনপ্রতিনিধিদের আচরণে শিক্ষার প্রতি যে ঔদাসীন্য প্রকট হইয়াছে, তাহা কেবল লজ্জার কারণ নহে, গভীর উদ্বেগের কারণও বটে। এখন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলিবার বিলম্বিত সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরে সেই নিষ্ক্রিয়তার অবসান ঘটাইয়া সর্বশক্তিতে ঝাঁপাইয়া পড়া তাঁহাদের কর্তব্য। তাহাতে অন্তত কিছুটা ক্ষতিপূরণ হইবে। বিশ্বাসীরা ইহাকে কৃত(অ)কর্মের প্রায়শ্চিত্ত হিসাবেও দেখিতে পারেন।
শাসকদের মনে রাখা দরকার, স্কুল খুলিয়া দিলেই এবং জীবাণু নাশের ব্যবস্থা করিলেই তাঁহাদের কাজ শেষ হইবে না। প্রত্যেকটি স্তরে, বিশেষ করিয়া স্কুলশিক্ষায়, আরও বিশেষ ভাবে গ্রাম এবং শহরের সরকারি স্কুলগুলির ছাত্রছাত্রীর লেখাপড়ার যে বিপুল ক্ষতি ইতিমধ্যে ঘটিয়া গিয়াছে, তাহা পূরণ করিয়া তাহাদের শিক্ষায় যথার্থ গতি আনিতে সমস্ত প্রকারে চেষ্টা করিতে হইবে। বহু ছেলেমেয়ে দারিদ্র ও অন্যতর কারণে শিক্ষার পাট সম্পূর্ণ চুকাইয়া দিয়াছে, আরও এক বিরাট অংশ কার্যত অধীত বিদ্যা এবং শিক্ষার অভ্যাস হইতে সম্পূর্ণরূপে বা বহুলাংশে সরিয়া গিয়াছে। তাহাদের শিক্ষার পরিসরে ফিরাইবার কাজ কেবল শিক্ষকদের উপর চাপাইয়া দেওয়া চলে না, সেই কাজে নাগরিক সমাজের সক্রিয় সহযোগিতা অপরিহার্য, অপরিহার্য সরকারি সাহায্য, উদ্যম এবং যথার্থ অনুপ্রেরণা। প্রশাসন এবং সমাজ যদি একযোগে এই কঠিন সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করে, পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষার ভুবনে বিপুল ব্যর্থতার কলঙ্ক পিছনে রাখিয়া নূতন ইতিহাস রচনা করিতে পারে। রাজ্যের শাসকরা নিজেদের সদিচ্ছা ও সামর্থ্য লইয়া অনেক বড় বড় কথা বলিয়া থাকেন। এই একটি কাজ করিয়া দেখাইবেন কি?