সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তিও বলিয়াছে যে, বৃদ্ধির হারটি অস্বাভাবিক রকমের বেশি দেখাইতেছে— লো বেস এফেক্ট-এর কারণে। কিন্তু, বিজেপির মেজো-সেজো নেতাদের উচ্ছ্বাস দেখিয়া সেই কথা বুঝিবার উপায় নাই। উপায় তাঁহারা রাখেন নাই বলিয়াই নাই— অর্থব্যবস্থার পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের নাকটি এত বার ঘষিয়া গিয়াছে যে, তাঁহারা যে কোনও প্রকারে সাফল্যের একটি বিভ্রম সৃষ্টি করিতে মরিয়া। নচেৎ, লো বেস এফেক্ট-এর কথাটি তাঁহারা কেহই বুঝেন নাই, এই কথাটি বিশ্বাস করিতে হইলে দল হিসাবে বিজেপির সামগ্রিক বুদ্ধ্যঙ্ক লইয়া সন্দেহ উপস্থিত হইবে। অর্থব্যবস্থায় ঘটনাটি কী ঘটিয়াছে, তাহা বুঝিতে অবশ্য পঞ্চম শ্রেণির পাটিগণিতের জ্ঞান থাকাই যথেষ্ট। ধরা যাউক, ২০১৯ সালের এপ্রিল হইতে জুন, এই তিন মাসে দেশের জিডিপি ছিল ১০০ টাকা। ২০২০ সালে সেই একই সময়কালে— অতিমারির আক্রমণে, এবং তাহা সামলাইতে সরকারের প্রভূত ব্যর্থতার কারণে— ভারতীয় অর্থব্যবস্থা সঙ্কুচিত হইল প্রায় ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ, ২০২০ সালের এপ্রিল হইতে জুন, এই তিন মাসে জিডিপি দাঁড়াইল ৭৬ টাকায়। ২০২১-২২ অর্থবর্ষের প্রথম তিন মাসের বৃদ্ধির হিসাব কষা হইবে এই ৭৬ টাকার উপর— অঙ্কটি ‘অ-স্বাভাবিক’ রকম কম, যাহাকে ‘লো বেস’ বলা হইয়া থাকে। ৭৬ টাকার ভিত্তিতে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি হইলে বর্তমান অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকের শেষে ভারতের জিডিপি দাঁড়ায় ৯১.২০ টাকায়। অর্থাৎ, বিজেপির মেজো-সেজো নেতারা যে বৃদ্ধির হারকে অভূতপূর্ব বলিয়া চালাইতে উদ্গ্রীব— সেই হারে বৃদ্ধির পরও ২০২১ সালের জুন মাসের শেষ দেশের জিডিপির অঙ্কটি ২০১৯ সালের একই সময়কালের জিডিপির অঙ্কের তুলনায় ৮.৮ শতাংশ কম। বিজেপির নেতারা যদি বলেন যে ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’, তবে কথাটি মিথ্যা হইবে না— মোদীর দেশ ব্যতীত দুনিয়ার আর কোথাও এতখানি লেজে-গোবরে অবস্থা হয় নাই।
এক দিকে অর্থব্যবস্থা পরিচালনায় অদক্ষতা, আর অন্য দিকে মানুষকে বোকা বানাইয়া সেই অদক্ষতা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা— এই দুইটি পরস্পরের পরিপূরকও বটে, আবার একটি ভয়ঙ্কর জুড়িও বটে। ব্যর্থতা স্বীকার করিবার সৎসাহসটুকু থাকিলে তবুও ঘুরিয়া দাঁড়াইবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু, ব্যর্থতাকে অভূতপূর্ব সাফল্য বলিয়া চালাইবার ঔদ্ধত্য সেই সম্ভাবনাকে মারিয়া রাখে। ঘটনা হইল, বর্তমান ত্রৈমাসিকে ২০ শতাংশ বৃদ্ধির হার উচ্ছ্বাসের নহে, গভীর উদ্বেগের কারণ। উদ্বেগ, কারণ দুইটি গোটা বৎসর ভারতীয় অর্থব্যবস্থা হইতে মুছিয়া গিয়াছে। ২০১৯ সালে এই সময় ভারত যে অবস্থায় ছিল, দুই বৎসর পার করিয়াও সেই অবস্থায় ফেরা সম্ভব হয় নাই। তাহার কারণ ইহাই যে, অতিমারির ঘায়ে ধরাশায়ী হইবার পূর্বেই ভারতীয় অর্থব্যবস্থাকে মারিয়া রাখিয়াছিল বর্তমান সরকারের অদক্ষ আর্থিক পরিচালনা, ভ্রান্ত নীতি। ধরিয়া লওয়া যায়, নূতন কোনও ধাক্কা না লাগিলে— এবং সরকার নূতন কোনও অবিমৃশ্যকারিতা না করিলে— আরও এক বৎসরের মধ্যে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার পক্ষে কোভিড-পূর্ববর্তী ধাপে ফেরা সম্ভব হইবে। কিন্তু, অর্থব্যবস্থায় যদি কোভিড ও সরকারি অদক্ষতার যুগপৎ আঁচড় না পড়িত, তবে এই তিন বৎসরে জিডিপির পরিমাণ আগাইয়া যাইত অনেকখানি। এই যে পূর্বের এবং বর্তমান গতিপথের মধ্যে ফারাক, তাহাকে পূরণ করিবার কাজটি অতি কঠিন। কোনও কোনও অর্থশাস্ত্রীর হিসাবে, সেই ব্যবধান মুছিতে হয়তো দেড় দশক সময়ও লাগিতে পারে। তাহাও সম্ভব হইবে, যদি সরকার নাগরিকের সহিত ছলনার কু-অভ্যাসটি ত্যাগ করিয়া আর্থিক বৃদ্ধির প্রতি প্রকৃতার্থে নিষ্ঠাবান হয়, তবেই। তাহার প্রথম ধাপ, দোষ স্বীকার করিতে শেখা। নরেন্দ্র মোদীরা স্বীকার করিয়া লউন যে, তাঁহারা এত দিন শুধু ব্যর্থই হইয়াছেন। অতঃপর, সেই ব্যর্থতা দূর করিতে সচেষ্ট হউন।