অটলবিহারী বাজপায়ীর আমলে যাহা হয় নাই, এমনকি নরেন্দ্র মোদীও প্রথম চেষ্টায় যাহা পারেন নাই, এই বার তাহাই সম্ভব হইল। এয়ার ইন্ডিয়া নামক শ্বেতহস্তীটি শেষ অবধি সরকারি হাতিশালের বাহিরে গেল। বিদায়কালে তাহার মোট দেনার পরিমাণ ৬১,৫৬২ কোটি টাকা— এবং, যত দিন সংস্থাটি টিকিয়া থাকিত, প্রাত্যহিক ক্ষতির পরিমাণ হইত ২০ কোটি টাকা। প্রশ্ন হইল, ২০০১ সালে যাহা হয় নাই, ২০১৮ সালেও যাহা হয় নাই, এই বার তাহা সম্ভব হইল কী উপায়ে? এয়ার ইন্ডিয়া নামক সংস্থাটির আকর্ষণ গত দুই দশকে তিলমাত্র বাড়িয়াছে, এমন দাবি করিবার প্রশ্নই নাই। তাহা হইলে? গত দুই বারের সহিত বর্তমান প্রচেষ্টার ফারাক এইখানেই যে, এই বার আর সরকার শ্বেতহস্তীর লেজ আঁকড়াইয়া থাকিবার চেষ্টা করে নাই। আংশিক বিলগ্নিকরণ নহে, এই বার সরাসরি সংস্থাটি বেচিবার চেষ্টা করাতেই সাফল্য মিলিল। সংস্থার পরিচালনায় সরকারের ভূমিকা থাকিবে, এই আশঙ্কাই এত দিন লগ্নিকারীদের এয়ার ইন্ডিয়া হইতে দূরে রাখিয়াছিল। এয়ার ইন্ডিয়ার ন্যায় ভয়াবহ অবস্থায় থাকা বিমানসংস্থাকে লাভজনক করিয়া তুলিতে হইলে যে পদক্ষেপগুলি প্রয়োজন, সংস্থার পরিচালনায় সরকারের অংশীদারি থাকিলে তাহার অধিকাংশই করা সম্ভব হইত না বলিয়াই লগ্নিকারীদের আশঙ্কা ছিল।
কেন সংস্থাটি এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পৌঁছাইয়াছে, সরকারের প্রতি লগ্নিকারীদের অনাস্থায় সেই কারণটি লুকাইয়া আছে। বিমান সংস্থা পরিচালনা করা সরকারের কাজ নহে। যে মুহূর্ত হইতে ভারতের আকাশরেখাটি বেসরকারি সংস্থার জন্য খুলিয়া গিয়াছে, সরকারি বিমানসংস্থার পতনেরও সূচনা সেই মুহূর্তেই। তাহার কারণ, প্রতিযোগিতার বাজারে টিকিয়া থাকিবার জন্য যে কুশলতা প্রয়োজন, সরকারের তাহা নাই। বাণিজ্যিক লাভ নহে, সরকারি সংস্থামাত্রেই পরিচালিত হয় ভিন্নতর উদ্দেশ্যে। ২০০৯-১০ সাল হইতে বিভিন্ন সরকার রাজকোষ হইতে এক লক্ষ কোটি টাকারও বেশি খরচ করিয়াছে এয়ার ইন্ডিয়ার লোকসান পুষাইতে, অথবা তাহার জন্য ঋণের সংস্থান করিতে। টাকার অঙ্কটি সামান্য নহে। টাকাটি আকাশ হইতে পড়ে নাই— ইহা ভারতীয় করদাতাদের অর্থ। সেই সব ভারতীয়েরও, যাঁহাদের কোনও দিন বিমান সফরের প্রয়োজন পড়ে না, সেই সামর্থ্যও হয় না। কোনও যুক্তিতেই এই অপচয়কে সমর্থন করা চলিতে পারে না। এই টাকা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে, শিক্ষায়, অথবা পরিকাঠামো নির্মাণে ব্যয় হইলে সাধারণ মানুষের উপকার হইত। সেই ক্ষেত্রগুলিতে মনোনিবেশ করাই সরকারের কাজ।
এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রি হওয়ায় শ্বেতহস্তী পুষিবার ঝক্কিটি সরকারের ঘাড় হইতে নামিল, তাহা ঠিক। কিন্তু, শেষ অবধি যে দামে, এবং যে শর্তে, সংস্থাটি বিক্রয় হইল, তাহা দুর্ভাগ্যজনক। সংস্থার ৬১,৫৬২ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে টাটা গোষ্ঠী মিটাইয়াছে ১৫,৩০০ কোটি টাকা; তাহা ভিন্ন সরকার হাতে পাইয়াছে আরও ২৭০০ কোটি টাকা। এয়ার ইন্ডিয়ার যত স্থাবর সম্পত্তি আছে, তাহা বেচিয়া হাতে আসিবে আরও ১৪,৭০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, বিড়ালটি চলিয়া গেলেও তাহার পড়িয়া থাকা হাসিটির ন্যায় সরকারের জন্য পড়িয়া থাকিল প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকার দেনা। তাহার দায় প্রকৃত প্রস্তাবে দেশের নাগরিকদের উপরই বর্তায়। যে সমস্ত সম্পদের জোরে একটি বিমান সংস্থার দাম নির্ধারিত হয়— বিমানের সংখ্যা, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রুটের ছাড়পত্র, বিভিন্ন বিমানবন্দরে বিমান রাখিবার অধিকার ইত্যাদি— এয়ার ইন্ডিয়ার সবই ছিল। ছিল না শুধু সরকারি কাণ্ডজ্ঞান— ঠিক সময়ে সংস্থাটি বেচিয়া দেওয়ার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। ৩০,০০০ কোটি টাকার বকেয়া দেনায় ভারত সেই ঘাটতিই শোধ করিবে।