আরও এক বার পেঁয়াজের দাম আকাশ ছুঁইতেছে। আরও এক বার সেই অ-স্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিজনিত লাভের ছিটাফোঁটাও কৃষকের ঘরে পৌঁছাইতেছে না— লাভের গুড় খাইতেছে মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি। আরও এক বার সরকারি ব্যর্থতা প্রকট। সংবাদে প্রকাশ, খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম যখন কিলোগ্রামপ্রতি পঞ্চাশ টাকা ছাড়াইয়া গিয়াছে— যাহার একটি অংশ ক্রমবর্ধমান পরিবহণ ব্যয়ের কারণে বাড়িতেছে, কিন্তু তাহাই সবটুকু নহে— কৃষক তখনও দশ টাকার অধিক দাম পাইতেছেন না। তাঁহারা অসহায়, কারণ ফসল উঠিলে তাহাকে তৎক্ষণাৎ বেচিয়া দেওয়া ভিন্ন তাঁহাদের উপায় নাই। ফসল রাখিবার মতো হিমঘর গড়িয়া উঠে নাই। সরকার নিজেও কাজটি করে নাই, বেসরকারি ক্ষেত্রকেও করিতে দেয় নাই। নাচার কৃষকরা পাইকারি বাজারে পণ্যের জোগান অব্যাহত রাখিলে বাজারের নিয়ম মানিয়াই সেই ফসলের দাম তলানিতে পড়িয়া থাকে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, পশ্চিমবঙ্গে যে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির সুফল হইতে কৃষকরা বঞ্চিত হইতেছেন, অনতিঅতীতে তাহার প্রচলন হইয়াছিল কৃষকের লাভ বাড়াইবার উদ্দেশ্যেই। বর্ষার পেঁয়াজ এই রাজ্যের প্রচলিত ফসল নহে। ভিন্রাজ্য হইতে বীজ আনাইয়া, প্রশিক্ষণ লইয়া এই চাষের ব্যবস্থা হইয়াছিল। অথচ, শেষ পর্যন্ত সেই ফসলও মধ্যস্বত্বভোগীদের লাভের বহর বাড়াইতেছে।
গত বৎসর কেন্দ্রীয় সরকার যে কৃষি আইন পাশ করিয়াছিল, সেই আইন কৃষকের এই সমস্যার সমাধান করিতে পারিত কি? আইনগুলির মধ্যে যে আংশিক সংস্কারমুখিতা ছিল, তাহা অস্বীকার করা যায় না। যেমন, যে কোনও রাজ্যের কৃষকের জন্যই গোটা দেশের বাজার খুলিয়া দেওয়া, যে কোনও ক্রেতার নিকট পণ্য বিক্রয়ের স্বাধীনতা, অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের শৃঙ্খল হইতে মুক্তি। কিন্তু, সেই স্বাধীনতা, সেই মুক্তি কৃষকের কোনও উপকারে লাগিবে কি না, তাহার হদিস এই আইনে নাই। যথেষ্ট সংখ্যায় এবং কৃষক-বান্ধব ভঙ্গিতে কৃষি ও কৃষি বিপণন পরিকাঠামো নির্মিত না হইলে কৃষকের নিকট ক্রেতার চেহারা পাল্টাইবে মাত্র, চরিত্র নহে। এই নূতন আইনেও হিমঘরের সন্ধান নাই; মাঠ হইতে ফসল তুলিবার পর বাজারে যথেষ্ট দাম উঠিবার পূর্ব পর্যন্ত কৃষক সেই ফসল লইয়া কী করিবেন, আইন তাহা বলিয়া দেয় নাই। কাজেই আশঙ্কা হওয়া স্বাভাবিক যে, নূতন কৃষি আইনের ফলে উপকার যদি কাহারও হয়, তবে হইবে কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়ীর। কৃষি বাজারে যাঁহারা কালক্রমে একচেটিয়া ক্রেতা হইয়া উঠিতে পারেন বলিয়াই আশঙ্কা।
প্রতিযোগিতার খোলা হাওয়াই পারিত এই ব্যবস্থা পাল্টাইতে। এক বা দুই জন বৃহৎ ক্রেতার জন্য খিড়কি নহে, কৃষিপণ্যের সিংহদুয়ারটি যদি প্রতিযোগিতার জন্য খুলিয়া দেওয়া হইত, যদি মাল্টি-ব্র্যান্ড রিটেলের জন্য, বিদেশি পুঁজির জন্যও ক্ষেত্রটি উন্মুক্ত হইত, তাহা হইলে পরিস্থিতি পাল্টাইতে পারিত। জোগান-শৃঙ্খলের দৈর্ঘ্য কমিলে যেমন ক্রেতা অপেক্ষাকৃত কম দামে পণ্য পাইতেন, তেমনই কৃষকও লাভবান হইতেন। ফসল সংরক্ষণের কাজটিও কুশলী ভঙ্গিতে হইতে পারিত। কিন্তু, এই একটি প্রশ্নে ভারতীয় রাজনীতিতে এক আশ্চর্য মতৈক্য দেখা যায়। সঙ্ঘ পরিবারও যেমন মাল্টি-ব্র্যান্ড রিটেলের বিরোধী, হরেক রাজনৈতিক প্রশ্নে তাহাদের বিপ্রতীপ অবস্থানে থাকা বামপন্থীরাও তাহার বিরোধী। সেই বিরোধের মূলে আছে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ। সঙ্ঘ পরিবার খুচরা ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষা করিতে চাহে; বামপন্থীরা মূলত মধ্যস্বত্বভোগীদের স্বার্থ দেখিতেন। কিন্তু, কোনও রাজনীতিই কৃষকদের লাভের কথা ভাবে নাই। ভাবিবে, সেই আশাও ক্ষীণ। ফলে, বাজারের অবস্থা যেমনই থাকুক না কেন, কৃষককে দারিদ্রেই বাঁচিতে হইবে, ইহাই ভারতের বাস্তব।