বিশ্বের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার শ্রেষ্ঠ আসরে পদক জয় করিতে কী কী প্রয়োজন? নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়, প্রতিভা ও সাধনা, পরিবেশ ও প্রশিক্ষণ, এই সবই— এবং তাহারও অধিক কিছু। প্যারালিম্পিক্সে সোনার মেডেলজয়ী অবনী লেখারা বা সুমিত অন্তিল, রৌপ্যপদক জয়ী ভাবিনাবেন পটেল, দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া, মারিয়াপ্পান থাঙ্গাভেলু হইতে নিষাদ কুমার বা যোগেশ কাঠুনিয়া, ব্রোঞ্জ জয়ী সুন্দর সিংহ গুর্জর, সিংহরাজ আধানা, শরদ কুমারদের প্রশ্ন করিলে তাঁহারা বলিবেন ক্রীড়াক্ষেত্রের বাহিরে, বাস্তব জীবনে পার হইয়া আসা সহস্র বাধাবিপত্তির কথা। অলিম্পিক্সে রেকর্ড সংখ্যক পদক জয়ের পর প্যারালিম্পিক্সেও ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের সাফল্য কীর্তিত হইতেছে, আগামী দিনগুলিতে পদক ও জয়ধ্বনি দুই-ই বাড়িবে বলিয়াই আশা। সেই সূত্রেই উঠিয়া আসিতেছে খেলোয়াড়দের প্রতিবন্ধকতা জয়ের কথাও।
এই প্রতিবন্ধকতা বহুলাংশে শারীরিক, সর্বাংশে নহে। বরং প্যারালিম্পিয়ানদের নিজেদের কথাতেই স্পষ্ট, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় তাঁহাদের পক্ষে তবু সহজ— সামাজিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করাই কঠিনতর। অল্পবয়সে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হইয়া, পথদুর্ঘটনায় পড়িয়া, যন্ত্রের ভিতর হাত ঢুকিয়া গিয়া— এমন নানা ঘটনায় এই খেলোয়াড়দের স্থায়ী শারীরিক ক্ষতি হইয়াছে। সামান্য বলিরেখায় বা কেশবৈরূপ্যে মানুষ চিন্তিত হইয়া পড়ে— অঙ্গহানি হইবার বা অসহ যন্ত্রণার সহিত বাকি জীবন কাটাইবার বিভীষিকা সহজেই অনুমেয়। শারীরিক যন্ত্রণা ও তজ্জনিত দুঃসহ মানসিক চাপ অবনী বা সুমিতদের ক্ষুদ্র, ন্যুব্জ করিয়া রাখিতে তো পারেই নাই, বরং তাঁহারা এক-একটি ক্রীড়া ও তাহার শ্রেষ্ঠ প্রতিযোগিতা-ক্ষেত্রকে নিজ প্রতিভা প্রকাশের, দেশের গৌরব বিস্তারেরও পরিসর রূপে বাছিয়া লইয়াছেন। আজ পদক জয়ের আলোয় অতীতের অন্ধকারও উঠিয়া আসিতেছে, যখন তাঁহাদের পাশে সমাজ ছিল না, জনসমর্থন ছিল না, জীবন কাটিত মুখ্যত একাকী, কতিপয় আত্মজনের সহায়তায়। সরকারি ‘টপস’ প্রকল্প, ক্রীড়া মন্ত্রক, বিভিন্ন সংস্থার সহায়তার কথা নিশ্চয়ই বলিবার, কিন্তু বুঝিতে হইবে, ভারতে ক্রীড়াক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ হইতে পরিকাঠামো কিছুই যথেষ্ট নাই, তাহা বিশ্বমানের নহে। এই প্যারালিম্পিয়ানদের সাফল্যের গুরুত্ব তাই কম কথা নহে।
বিশেষত নারী খেলোয়াড়দের কথা আলাদা করিয়া বলিবার। একুশ শতকের ভারতে কন্যাসন্তানের জন্ম এখনও বিষাদ লইয়া আসে, জিনস পরিলে কিশোরীর জীবনাশঙ্কা এমনকি মৃত্যু ঘটে, সেখানে একটি মেয়ে শুটিং রাইফেল-পিস্তল, টেবিল টেনিস ব্যাট, ব্যাডমিন্টন র্যাকেট হাতে তুলিতেছেন, বিশ্বমানের প্রতিযোগীদের সহিত লড়িতেছেন বক্সিং বা ভারোত্তোলনে— ইহা বৈপ্লবিক। অলিম্পিক্স বা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের আসরে সফল নারী খেলোয়াড়দের মুষ্টিবদ্ধ প্রত্যয়, অতএব, পুরুষের সহিত তুলনায় সতত পীড়িত, ন্যূনতম খাদ্য-শিক্ষা-সুযোগ-সম্মানে বাঁচিয়া থাকা ভারতীয় নারীদের জিতাইয়া দেয়। প্যারালিম্পিক্সে হুইলচেয়ারে বসিয়াই এক-এক জন অবনী বা ভাবিনা দেখাইয়া দেন যে, নারীকে সমানাধিকার দিতে কুণ্ঠিত সমষ্টির কুর্নিশ কী করিয়া আদায় করিতে হয়। সেই পাহাড়প্রমাণ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতার তুলনায় শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় তো কিছুই নহে।