জানা গেল, তহবিলে যতই প্রধানমন্ত্রীর নাম থাকুক, তিনি যতই তহবিলটির চেয়ারম্যান হউন, যতই তাঁহার সরকারের তাবড় মন্ত্রীরা তহবিলের অছি পরিষদের সদস্য হউন না কেন, পিএম-কেয়ার্স নামক তহবিলটির সহিত প্রধানমন্ত্রীর কোনও সম্পর্কই নাই। তহবিল প্রকল্পের শিরোনামে সরকারি প্রতীক অশোক স্তম্ভ ব্যবহৃত হইয়াছে, তাহার ঠিকানাও প্রধানমন্ত্রীর দফতরেরই— কিন্তু তাহাতে কী আসিয়া যায়? আদালতে হলফনামা পেশ করিয়া প্রধানমন্ত্রীর দফতর জানাইয়াছে যে, তহবিলটি শুধুমাত্র স্বেচ্ছা অনুদানের জোরেই চলে, তাহাতে সরকারি অর্থ নাই; কোনও সাংবিধানিক অধিকারবলেও তহবিলটি প্রতিষ্ঠিত হয় নাই, তাহার জন্য কোনও আইনও প্রণীত হয় নাই— অতএব তাহাকে রাষ্ট্রীয় প্রকল্প বলা চলিবে না; আইনের চোখে তাহাকে ‘রাষ্ট্র’ হিসাবে দেখাও চলিবে না। তাহা হইলে কেন রাজকোষ উজাড় করিয়া তহবিলের বিজ্ঞাপন করা হইল, কেনই বা সরকারি কর্মীদের এক দিনের বেতন কাটিয়া জমা করা হইল তহবিলে— এই প্রশ্নগুলির যথারীতি কোনও উত্তর নাই।
পিএম-কেয়ার্স তহবিল যাহাতে কোনও মতেই নজরদারির আওতায় না আসে, অনুমান করা চলে যে, তাহার জন্যই এই অস্বীকারের পালা চলিতেছে। ২০২০ সালের মার্চের শেষে তহবিলটি ঘোষিত হইয়াছিল। তাহার পরের দেড় বৎসরে কত টাকা জমা পড়িল, কোন খাতে কত খরচ হইল, কিছুরই স্পষ্ট হিসাব পাওয়া যায় নাই। তহবিলটি ‘সরকারি’ স্বীকৃতি পাইলে তাহা সিএজি-র নজরদারিতে আসিত, সংসদীয় কমিটির নিকট জবাবদিহি করিবার দায় থাকিত। সেই নজরদারি এড়াইবার তাগিদেই তহবিলটিকে অনাথ করিয়া প্রধানমন্ত্রী নিজের সংযোগ অস্বীকার করিতেছেন, এমন অভিযোগ উঠিলে তাহাকে অসঙ্গত বলা মুশকিল।
প্রধানমন্ত্রী আজ যতই দায় অস্বীকার করুন, পিএম-কেয়ার্স তহবিল সংক্রান্ত প্রশ্নগুলি তাঁহার দিকেই ধাবিত হইবে। আপৎকালীন পরিস্থিতি সামলাইবার জন্য দেশে প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ তহবিল থাকা সত্ত্বেও পিএম-কেয়ার্স নামক একটি তহবিল গঠন করিবার প্রয়োজন হইল কেন? দেশভাগ-বিধ্বস্ত ভারতে মানবিক সঙ্কটের মোকাবিলা করিবার জন্যই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু এই তহবিল গঠন করিয়াছিলেন, এবং নাগরিকদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছিলেন। কোনও সরলমতি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলিতে পারেন, প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ তহবিল হইতে যে হেতু পণ্ডিত নেহরুর নাম অনপনেয়, অতএব মোদী এমন একটি তহবিল গড়িতে চাহিয়াছেন, যাহার সৃষ্টিকর্তা হিসাবে থাকিবে শুধু তাঁহার নাম। গত সাত বৎসর নরেন্দ্র মোদী যে ভঙ্গিতে দেশ চালাইয়াছেন, তাহাতে ইতিহাসের গাত্রে নিজের নামটি খোদাই করিয়া দিবার প্রবণতা এতই প্রকট যে, সরলমতি পর্যবেক্ষকের কথাটি বিশ্বাস করিয়া ফেলা যায়। কিন্তু, কোনও শুভনাস্তিক পর্যবেক্ষক বলিবেন, জাতীয় ত্রাণ তহবিলে পাইপয়সার হিসাব রাখিতে হয়। পিএম-কেয়ার্সের গঠনশৈলীই এমন যে, টাকা কোথা হইতে আসে, আর কোথায় ভাসিয়া যায়, সেই হিসাব রাখিবার দায় নাই। ফলে, কালো টাকা সাদা করিতে, বা দলীয় তহবিলে টাকা জোগাইতে এই তহবিলটি তাৎপর্যপূর্ণ হইতে পারে। শুভনাস্তিকের কথায় কতখানি গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়, সেই সিদ্ধান্ত ব্যক্তির নিজস্ব। কিন্তু, যে অস্বচ্ছতা এই তহবিলকে ঘিরিয়া রাখিয়াছে, তাহার সর্বাঙ্গে বর্তমান জমানার নামাবলি। যে জমানায় প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন না, সরকার আইনসভার সদস্যদের সম্মুখীন হয় না, সরকারের অপছন্দ হইলে পরিসংখ্যান মুহূর্তে উধাও হইয়া যায়, সেই জমানায় এই অস্বচ্ছতাই ধর্ম। পিএম-কেয়ার্স তহবিলের ক্ষেত্রেও তাহার ব্যতিক্রম ঘটিল না।