সাম্য, স্বাধীনতা, ধর্ম, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ন্যায় ভারতে কি অতঃপর ডিজিটাল পরিষেবা পাইবার অধিকারটিও মৌলিক অধিকার হিসাবে গণ্য হইতে পারে? সম্প্রতি কেরল হাই কোর্টের একটি মন্তব্যে সেই ইঙ্গিত আছে। স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিবাহ করিবার জন্য অনলাইনের সুযোগ পাইতে আদালতের দ্বারস্থ হইয়াছিলেন এক যুগল। সেই মামলার প্রেক্ষিতে কেরল হাই কোর্ট ডিজিটাল পরিষেবাকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত কি না, এমন একটি প্রশ্ন তুলিয়াছে। দুই বিচারপতির বক্তব্য, ব্যাঙ্ক পরিষেবা হইতে রেশন কার্ড— সর্বত্র ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহারে মানুষ যখন বাধ্য, তবে আইন করিয়া এই অধিকারের বৈধতা দিবার কথা ভাবা প্রয়োজন নয় কি? প্রশ্নের আলোচনায় যাইবার আগে একটি বিষয় স্পষ্ট করা ভাল। অধিকার ও মৌলিক অধিকার বিষয় দুইটি এক নহে। সাধারণত ‘মৌলিক অধিকার’ বলিতে সেই অধিকারগুলিকেই বুঝায়, যাহার অনস্তিত্বে নাগরিকের সামগ্রিক অস্তিত্বই বিপন্ন হইয়া পড়ে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখিলে, ডিজিটাল পরিষেবা কি নাগরিকের ‘মৌলিক’ অধিকার হইতে পারে? এই পরিষেবার সঙ্গে নাগরিকের দৈনন্দিন প্রয়োজনের প্রশ্নটি জড়াইয়া আছে, অস্তিত্ব নহে। সমস্যা হইল, আজকাল হিন্দুদের গো-রক্ষা হইতে ডিজিটাল পরিষেবার প্রসঙ্গ— বহু বিষয়কে অধিকারের গণ্ডি ছাপাইয়া মৌলিক অধিকারে পর্যবসিত করিবার একটি প্রবণতা দেখা দিতেছে। ইহা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়, এমনকি বিপজ্জনক।
তবে কিনা, ‘মৌলিক’ না হইলেও নাগরিক অধিকারের প্রশ্নটি ডিজিটাল পরিষেবার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত এই অতিমারিকালে, যখন আর্থিক লেনদেন হইতে শিক্ষা— সর্বত্রই ডিজিটাল পরিষেবা কার্যত আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে, তখন নাগরিকের প্রয়োজনে সেই পরিষেবা ব্যবহারের অধিকারটি থাকা জরুরি। বিভিন্ন ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করিয়া সরকারের ডিজিটাল পরিষেবাকে নাগরিক প্রয়োজনে আরও বিস্তৃত ভাবে ব্যবহার করিবার বিষয়টি লইয়া ভাবনাচিন্তা জরুির। ভুলিলে চলিবে না যে, দেশের এক বৃহৎ সংখ্যক নাগরিক এখনও এই ডিজিটাল বৃত্তের বাহিরেই অবস্থান করিতেছেন। দ্রুত গতির ইন্টারনেট তো দূর স্থান, ডিজিটাল পরিষেবা ব্যবহারের উপযুক্ত ফোনও বহু নাগরিকের কাছে নাই। জনগোষ্ঠীর এক বৃহৎ অংশকে বাদ রাখিয়া কোনও দেশ সম্পূর্ণ ডিজিটাল হইতে পারে না।
অথচ, ভারতে সেই চেষ্টাই চলিতেছে। বিজেপি সরকার শুধুমাত্র যে অতিমারিকালে ডিজিটাল ব্যবস্থার উপর জোর দিয়াছে, তাহা নহে; অতিমারি-পূর্ব ভারতেও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অনলাইন শিক্ষা, ডিজিটাল লেনদেনে গুরুত্ব আরোপ করিয়াছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদীর ডিজিটাল ইন্ডিয়া স্লোগানের ছয় বৎসর বয়স হইয়া গেলেও তাহার উপযুক্ত পরিকাঠামো এত দিনে গড়িয়া উঠিল না; অতীব দুর্ভাগ্যজনক। এই পরিকাঠামোর অভাবেই গত দেড় বৎসর ধরিয়া দেশের অগণিত শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষার সুযোগ পাইলেন না। দেশকে ডিজিটাল বানাইতে হইলে প্রত্যেক নাগরিক যাহাতে সেই সুযোগ পান, তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে। এই গোড়ার কথাটির দিকে ইঙ্গিত করিবার জন্য কেরল হাই কোর্ট নিশ্চয় ধন্যবাদার্হ।