ফাইল চিত্র।
কুনাট্যের যবনিকা কি পড়িল? কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি সিদ্ধান্ত লইল যে, টেলিকম শিল্পে অ্যাডজাস্টেড গ্রস রেভিনিউ বা এজিআর-এর সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হইবে। দীর্ঘ কাল ধরিয়া এজিআর ভারতীয় টেলিকম শিল্পে বৃহত্তম বিরোধের কেন্দ্রে। এত দিন নিয়ম ছিল, টেলিকম সংস্থার যে কোনও ব্যবসা হইতে আয়ই এই এজিআর-এর অন্তর্গত হইবে। এবং, সেই অঙ্কের উপরই নির্ধারিত হইবে সংস্থার নিকট সরকারের পাওনাগন্ডা। টেলিকম সংস্থাগুলির দাবি ছিল, শুধুমাত্র মূল টেলিকম ব্যবসা হইতে অর্জিত আয়ই এজিআর-এর হিসাবে থাকুক। বলা প্রয়োজন যে, সরকারের অবস্থানটি অন্যায্য ছিল। সংজ্ঞা পরিবর্তনের মাধ্যমে সেই দীর্ঘমেয়াদি ভ্রান্তি সংশোধন করিয়া লওয়া হইতেছে। সরকার আরও জানাইয়াছে যে, সংস্থাগুলি বকেয়া টাকা শোধ করিতে চার বৎসর সময় পাইবে। অন্য দিকে, এই ক্ষেত্রে ‘অটোমেটিক রুট’-এর মাধ্যমে একশত শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নিতেও ছাড়পত্র দিয়াছে সরকার। অর্থাৎ, অন্তত চার বৎসরের জন্য টেলিকম সংস্থাগুলির হাতে বিনিয়োগযোগ্য অর্থ থাকিবে। সিদ্ধান্তটি তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতের টেলিকম ক্ষেত্রে যে তিনটি সংস্থা বর্তমানে উপস্থিত, তাহাদের মধ্যে দুইটি সংস্থা কম-বেশি অর্থাভাবে ভুগিতেছে। ভোডাফোনের সঙ্কট তীব্রতর, কিন্তু এয়ারটেলও সচ্ছল নহে। এই অবস্থায় সরকারের সিদ্ধান্তটি সংস্থাগুলিকে স্বস্তি দিবে তো বটেই, ভারতীয় টেলিকম গ্রাহকদেরও বড় ধরনের বিপদ হইতে বাঁচাইবে।
বিপদটি বাজারে একচেটিয়া আধিপত্যের। টেলিকমক্ষেত্রের পরিস্থিতি যে দিকে গড়াইতেছিল, তাহাতে আশঙ্কা তীব্রতর হইতেছিল যে, শেষ অবধি হয়তো বাজারে টিকিয়া থাকিবে একটিমাত্র সংস্থা। অথবা, একটি প্রবল এবং একটি ক্ষীণবল সংস্থা— যেখানে স্বভাবতই বাজারের নিয়ন্ত্রণ থাকিবে প্রবল সংস্থাটির হাতে। কোনও সংস্থার হাতেই কোনও বাজারের একচেটিয়া দখল ক্রেতার স্বার্থের পরিপন্থী। টেলিকমের ন্যায় অত্যাবশ্যক পরিষেবার ক্ষেত্রে সেই বিপদ প্রবলতর। টেলিকমের বাজারে প্রতিযোগিতার সুফল ভারত দেখিয়াছে। যে পরিষেবা তাহার সূচনালগ্নে শুধুমাত্র অতিধনীদের আয়ত্ত ছিল, মাত্র দশ-পনেরো বৎসরে তাহা কার্যত সকলের হাতে পৌঁছাইয়া গিয়াছিল। গত দশ বৎসর সেই টেলিকম বিপ্লবের সুফল ভোগ করিয়াছেন ভারতীয় গ্রাহকরা। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়াছে, কী ভাবে একটি মোবাইল ফোন মানুষের জীবিকার চিত্রটি পাল্টাইয়া দিয়াছে, কী ভাবে অর্থনীতির মূলস্রোতে মানুষের অন্তর্ভুক্তি হইয়াছে। বর্তমানে ভারতের প্রশাসনিকতা বহুলাংশে মোবাইল পরিষেবা-নির্ভর। ফলে, তাহার ব্যবহারও অপরিহার্য। এই অবস্থায় টেলিকমের বাজারটি যাহাতে কোনও একটি সংস্থার একচেটিয়া দখলে না চলিয়া যায়, তাহা নিশ্চিত করা সরকারের কর্তব্য।
মন্ত্রিসভার বর্তমান সিদ্ধান্তটি সাময়িক ভাবে হইলেও সেই কাজটি করিয়াছে। কিন্তু, এই স্বস্তি দীর্ঘমেয়াদি হইবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করিতেছে সরকারের উপর। বারে বারেই অভিযোগ উঠিয়াছে যে, এই সরকার কতিপয় বিশেষ শিল্পগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় অধিকতর আগ্রহী। কথাটি শুধু টেলিকম ক্ষেত্রের জন্যই নহে, অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রের জন্যও প্রযোজ্য। এই প্রবণতাটি ত্যাগ করিতে হইবে। স্মরণে রাখিতে হইবে যে, বাজার অর্থনীতিতে সরকারের প্রধানতম দায়িত্ব প্রতিযোগিতার পরিবেশ বজায় রাখা। কোনও সংস্থা যদি নিজেদের আর্থিক সামর্থ্যের জোরে প্রতিযোগিতার নিয়ম লঙ্ঘন করিয়া অন্য সংস্থাকে বাজারছাড়া করিতে চাহে— তাহা আটকানোই সরকারের কর্তব্য। মোট কথা, নিয়ন্ত্রক হিসাবে সরকারকে, এবং নজরদারি সংস্থাকে, নিরপেক্ষ হইতেই হইবে। প্রতিযোগিতাকে বিসর্জন দিয়া সাঙাততন্ত্রের আবাহন করিলে তাহা অর্থব্যবস্থার পক্ষে প্রাণঘাতী।