জওহরলাল নেহরু লিখিয়াছিলেন, ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক পরিসরে গান্ধীজির আগমনে ‘ভয়ের অবসান’ হয়, দেশবাসী রাষ্ট্রক্ষমতার ভীতি হইতে আপনাকে মুক্ত করিয়া শাসকের মুখোমুখি দাঁড়াইয়া আপনার হক দাবি করে। স্বাধীন দেশের বৃহত্তম রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে শাসক বিজেপির নেতারা দিনের পর দিন প্রবল উদ্যমে যে বার্তা প্রচার করিয়া আসিতেছেন তাহা সাহসের নহে, ভয়ের। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, তাঁহার দলের বিবিধ নেতা-মন্ত্রী, সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বৃহত্তম রাজ্যের নাগরিকদের একাদিক্রমে ভয় দেখাইতেছেন। রাজ্যের উন্নয়নের বার্তা নহে, দারিদ্র, বেকারত্ব, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের বিপুল ঘাটতি দূর করিবার কথা নহে, তাঁহাদের প্রথম এবং প্রধান বক্তব্য: বিরোধীরা— বিশেষত সমাজবাদী পার্টি— ভোটে জয়ী হইয়া ক্ষমতায় ফিরিলে অপরাধীদের দাপট ফিরিয়া আসিবে, কেহ আর শান্তিতে বাস করিতে পারিবেন না, সুতরাং— খবরদার!
রাজনীতিতে অপরাধীদের ভূমিকা, শাসকের প্রশ্রয়ে ও প্ররোচনায় তাহাদের দাপট, দুঃশাসনের তাড়নায় নাগরিকের দুর্দশা— এই সকল সমস্যাই ভারতে তথা উত্তরপ্রদেশে অতিপরিচিত। নাগরিকরা বিলক্ষণ জানেন, সরকার বদলাইলে অপরাধীদের পরিচিতি এবং ঝান্ডা বদলায়, দুঃশাসন নির্মূল হয় না। আদিত্যনাথের জমানায় শাসনের হাল কী হইয়াছে, তাহা সর্বজনবিদিত। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁহার সহ-প্রচারকরা বোধ করি তাহা লইয়া বিন্দুমাত্র ভাবিত নহেন। মনে করিবার কারণ আছে যে, তাঁহাদের সমস্ত ভীতিপ্রদর্শনের এক এবং অদ্বিতীয় লক্ষ্য: মেরুকরণ। এই প্রচারের ছকটি তাঁহাদের কল্যাণে অতিমাত্রায় পরিচিত হইয়াছে। অপরাধী, সংখ্যালঘু ও বিরোধী রাজনীতি— এই তিনটিকে সেই ছক একাকার করিয়া দেখায় এবং সেই বিকৃত-দর্শনের মাধ্যমে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু’দের মনে ভীতি উৎপাদন করিয়া তাঁহাদের ভোট সংগ্রহ করিতে চাহেন। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে এবং ২০১৭ সালে বিধানসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে শাসক দল প্রবল ভাবে এই রাজনীতিকে কাজে লাগাইয়াছে, ২০২২-এও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে। চলিতেছে বিন্দুমাত্র রাখঢাক না করিয়া। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং তাঁহার ভোট-প্রচারে মুজফ্ফরনগরে ২০১৩ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রসঙ্গ টানিয়া আনিয়াছেন, উদ্দেশ্য অনুমান করিতে কাহারও কোনও অসুবিধা হয় নাই।
এবং, সর্বাপেক্ষা উদ্বেগের কারণ ইহাই যে, এই নিরাবরণ বিভাজনের রাজনীতিই ক্রমশ সমাজের এক বিরাট অংশের দৃষ্টিতে যেন ‘স্বাভাবিক’ হইয়া পড়িয়াছে। যেন ভোটের প্রচার এমনই হইবার কথা। ধর্মের ভিত্তিতে, সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষকে মানুষ হইতে ভাগ করিয়া, এক ভাগ মানুষকে অন্য ভাগ মানুষের চোখে ভীতিপ্রদ করিয়াই যেন রাজনীতির ফসল তুলিতে হয়, তাহাই মানবজমিন চাষ করিবার উচ্চফলনশীল প্রকৌশল। এই ভয়ঙ্কর রাজনীতির বিরুদ্ধে রাজ্য তথা দেশের সমাজ একযোগে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করিতেছে না, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নিন্দা-সমালোচনা সবই অতিমাত্রায় সংযত, স্তিমিত। উদ্বেগ এইখানেই। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের ফল কী হইবে, ভোটদাতারা মেরুকরণের রাজনীতিকেই গ্রহণ করিবেন না তাহার সমুচিত জবাব দিবেন, শাসকদের ভীতিপ্রদর্শনে বিভ্রান্ত হইবেন না গত পাঁচ বৎসরের, বিশেষত অতিমারির দুই বৎসরের, অকল্পনীয় অভিজ্ঞতা স্মরণে রাখিবেন— প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যৎই বলিতে পারে। কিন্তু উদ্বেগ তো কেবল একটি রাজ্যকে লইয়া নহে, উদ্বেগ সমগ্র দেশটিকে লইয়া। যে দেশকে রবীন্দ্রনাথ ভারততীর্থ বলিয়াছিলেন। নরেন্দ্র মোদীরা তীর্থ বলিতে যাহা বুঝিয়া থাকেন, তাহা হইতে রবীন্দ্রনাথ অনেক দূরে বাস করেন। ভিন্ন মেরুতে।