economy

অনাস্থা প্রস্তাব

বিশ্বের বৃহত্তম টেলিকম বাজার ভারত, অথচ সেই বাজারে লগ্নি করিতে দেশি-বিদেশি কোনও সংস্থাই রাজি নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২২ ০৪:৪৯
Share:

অর্থনীতির আন্তর্জাতিক মঞ্চ হইতে ক্রমেই মিলাইয়া যাইতেছিল ভারতের নাম। ২০২১ সাল হঠাৎ ঘুরিয়া দাঁড়াইবার ইঙ্গিত দিল। ভারত বিষয়ে আন্তর্জাতিক আগ্রহের দুইটি উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট হইবে। এক, বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক লগ্নিকারীরা ভারতের শেয়ার বাজারে এমনই অর্থ লগ্নি করিয়াছেন যে, প্রকৃত অর্থব্যবস্থা যখন ধুঁকিতেছে, শেয়ার বাজার তখন আকাশ ছুঁইল; এবং দুই, স্টার্ট আপ-এর দুনিয়ায় যাহাকে ‘ইউনিকর্ন’ বলা হইয়া থাকে, অর্থাৎ যে সংস্থাকে বাজার ১০০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের বলিয়া বোধ করে, আমেরিকা ও চিনের বাহিরে তেমন সংস্থার সংখ্যা ভারতেই সর্বাধিক। প্রশ্ন উঠিবে যে, ভারত কি ঘুরিয়া দাঁড়াইতেছে? কিন্তু, প্রকৃত প্রস্তাবে যে প্রশ্নটি করা বিধেয়, তাহা হইল, ভারত বিপাকে পড়িয়াছিল কেন? যে দেশে এমন বিপুল বাজার; যে দেশে প্রযুক্তি-শিক্ষিত হইতে অদক্ষ, সকল গোত্রের কর্মীর প্রাচুর্য; এবং ভৌগোলিক ভাবে চিনের প্রতিস্পর্ধী আর্থিক-সামরিক শক্তি হিসাবে যাহাকে গড়িয়া তোলা প্রথম বিশ্বের অভীষ্ট হইতে পারিত, সেই দেশ পিছাইয়া পড়িল কেন? সেই পিছাইয়া পড়িবার ছবিটিকে গোষ্পদে ধরিয়া দিতে পারে একটি পরিসংখ্যান— ২০১২ সালে ভারতে মোট যতগুলি গাড়ি বিক্রয় হইয়াছিল, ২০২০ সালেও ততগুলিই গাড়ি বিক্রয় হইল। উচ্চাকাঙ্ক্ষাতাড়িত, দ্রুত উদীয়মান কোনও অর্থব্যবস্থার পক্ষে এই পরিসংখ্যান ভয়ঙ্কর। এবং, শুধু অতিমারির কারণ দর্শাইয়া এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা চলিবে না; বিপদ গভীরতর।

Advertisement

সেই বিপদের কারণ সন্ধান করিতে বসিলে অন্তত দুইটি বিষয় প্রকট হইয়া উঠে। প্রথমত, ভারত ক্রমে দরজা বন্ধ করিতেছে। ২০১৪ সাল হইতে আজ অবধি ভারতে ৩২০০টি পণ্যের উপর আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি পাইয়াছে— ভারতের মোট আমদানিকৃত পণ্যের ৭০ শতাংশ। ১৯৯১ হইতে দেশ যে পথে হাঁটিতেছিল, তাহার সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিমুখ। মনমোহন সিংহ মোট ১১টি বাণিজ্যচুক্তিতে স্বাক্ষর করিয়াছিলেন; নরেন্দ্র মোদী একটিও করেন নাই। এমনকি, সমগ্র এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল যে প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হইয়াছে, সেই রিজিয়োনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকনমিক পার্টনারশিপ হইতেও ভারত সযত্নে সরিয়া থাকিয়াছে। দেশে উৎপাদনের উপর জোর দিবার জন্য প্রোডাকশন-লিঙ্কড ইনসেনটিভ-এর ব্যবস্থা হইয়াছে— কিন্তু সেই উৎপাদনের লক্ষ্য আন্তর্জাতিক বাজার ধরিতে চাওয়া নহে, আমদানি প্রতিস্থাপন। ফলে, ভারত বহু ব্যয়ে মোবাইল ফোন নির্মাণ করিতেছে। এই দুর্বুদ্ধির সহিত ভারতের পূর্বপরিচয় আছে।

বিপদের দ্বিতীয় কারণ, দুইটি নির্দিষ্ট শিল্পগোষ্ঠীর প্রতি সরকারের অতি আনুকূল্য। তাহাতে কী বিপদ ঘটিতে পারে, টেলিকমের বাজারে তাহার মোক্ষম প্রমাণ মিলিয়াছে। বিশ্বের বৃহত্তম টেলিকম বাজার ভারত, অথচ সেই বাজারে লগ্নি করিতে দেশি-বিদেশি কোনও সংস্থাই রাজি নয়। এমনই অবস্থা যে, সরকারকে সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ার অধিগ্রহণ করিয়া ভোডাফোনকে বাঁচাইতে হইল। ইহা বর্তমান শাসকদের প্রতি বাজারের অনাস্থা প্রস্তাব— দুইটি বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করিতে সরকার বাজারের প্রতিযোগিতার ক্ষতি করিয়াছে, অন্যান্য সংস্থার সহিত বিমাতৃসুলভ আচরণ করিয়াছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হইল, এই সংস্থা দুইটি মূলত অভ্যন্তরীণ বাজারেই ব্যবসা করে, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নামিবার দায় তাহাদের নাই। সেই অভ্যন্তরীণ বাজার সরকার ইতিমধ্যেই নিরাপদ করিয়া দিয়াছে। ভারতের বিপদের কারণ হইল, ধনতন্ত্রের নামে দেশে নিছক সাঙাততন্ত্রের সাধনা চলিতেছে। কোনও প্রকৃত ধনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এই চোরাবালিতে পদক্ষেপ করিতে চাহিবে না। ঘুরিয়া দাঁড়াইতে হইলে সর্বাগ্রে এই ব্যাধির চিকিৎসা প্রয়োজন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement