এক সময় ভারতের বিশাল বাজার ধরিতে একাধিক বহুজাতিক গাড়ি নির্মাতা সংস্থা ভারতের বাজারে প্রবেশ করিয়াছিল। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে তাহারা আসিয়াছিল, অধিকাংশের ক্ষেত্রেই তাহা পূরণ হয় নাই। ‘ভারতীয় ক্রেতা’ ঠিক কী চাহেন, তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই বহুজাতিক সংস্থাগুলি। বিদেশের বাজারে বৃহৎ গাড়ি প্রস্তুত করিয়া তাহারা যেমন মোটা মুনাফা কামায়, তেমনটাই ভারতের বাজারেও তাহারা করিতে পারিবে বলিয়া ভাবিয়াছিল সংস্থাগুলি। অন্য দিকে, ভারতীয় ক্রেতারা জ্বালানি সাশ্রয়কারী, কমদামি গাড়ি পছন্দ করেন, যে কারণে ভারতীয় বাজারে ছোট গাড়ির চাহিদা বিপুল। যে কারণেই হউক, অধিকাংশ বিদেশি সংস্থাই সেই ছোট গাড়ির বাজারটিকে ধরিতে পারে নাই, ফলে তাহাদের ভারতীয় ব্যবসায় ঝাঁপ ফেলিতে হইয়াছে।
একই পথে হাঁটিতেছে আমেরিকান গাড়ি সংস্থা ফোর্ডও। গুজরাত এবং তামিলনাড়ুতে সংস্থাটি দুইটি কারখানা বন্ধ করিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছে। ইহার ফলে প্রায় ৭০০০ প্রত্যক্ষ কর্মী জীবিকা হারাইতে চলিয়াছেন। যে হেতু গাড়ি উৎপাদনের সহিত অন্যান্য অনুসারী শিল্পও জুড়িয়া থাকে, সুতরাং সেই সব ক্ষেত্রেও বহু মানুষ চাকুরি হারাইবেন বলিয়া মনে করা হইতেছে। ভারতীয় জনসংখ্যার তুলনায় যত মানুষ চাকরি হারাইবেন, তাহা তিলমাত্র হইলেও, ইহার তাৎপর্য গুরুতর। অন্য দিকে, বহুজাতিক সংস্থা পাততাড়ি গুটানোয় প্রধানমন্ত্রীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পটি বড়সড় ধাক্কা খাইতেছে। কারণ, ভারতে গাড়ির বাজার ধরিবার পাশাপাশি বহুজাতিক সংস্থাগুলি এই দেশে গাড়ি উৎপাদন করিয়া বিদেশের, বিশেষত ইউরোপের বাজারে রফতানি করিবার পরিকল্পনাও করিয়াছিল। কিন্তু ভারতের সঙ্গে ‘ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট’ লইয়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বনিবনা না হইবার কারণে তাহাদের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় নাই। ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট-এর মতো চুক্তির ক্ষেত্রে দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে ব্যবসার ক্ষেত্রে হরেক নীতি শিথিল থাকে, যার ফলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির মধ্যে বিভিন্ন জিনিসের আমদানি ও রফতানি মসৃণ ভাবে হইতে পারে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশ তাহার নীতি শিথিল না করিলে চুক্তি আটকাইয়া যায়।
গাড়ির ক্ষেত্রে ভারতের আমদানি কর বেশি থাকায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সহিত তাহার ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট হয় নাই। বিদেশি সংস্থাগুলি দেশি বাজারে ঢুকিয়া যদি দেশি সংস্থাগুলির বাজার পণ্ড করিয়া দেয়, সেই কথা ভাবিয়াই আমদানি কর বাড়াইয়া রাখিয়াছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই উচ্চ আমদানি করের কারণেই এখনও ভারতের বাজারে তাহাদের ইলেকট্রিক গাড়ি আনিতে পারে নাই আমেরিকান গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা টেসলাও। ইহাতে এক অর্থে ভারতের ক্ষতি হইতেছে। তাই কেন্দ্রীয় সরকারকে আমদানি করের বিষয়ে এমন করিয়া ভাবিতে হইবে, যাহাতে বিদেশি সংস্থাগুলি ব্যবসা করিতে আসিলেও দেশি সংস্থাগুলির কোনও ক্ষতি হইবে না এবং বিদেশের বাজারে গাড়ি বেচিতে বিদেশি সংস্থাগুলির কোনও সমস্যা থাকিবে না। তাহা হইলে ভারতের বাজার যেমন বিদেশি লগ্নি আকৃষ্ট করিবে, তেমনই বহু মানুষের কর্মসংস্থানও তৈরি হইবে। ইহাতে দেশের অর্থনীতিরই উন্নতি হইবে।