পুরসভার নিকট নাগরিক কী প্রার্থনা করেন, নির্বাচনের প্রাক্মুহূর্তে দাঁড়াইয়া প্রতিটি রাজনৈতিক দল, প্রত্যেক প্রার্থী সেই কথাটি এক বার ভাবিয়া লইতে পারেন। নাগরিক একটি বাসযোগ্য শহর চাহেন— যেখানে মানুষকে ফুটপাত ছাড়িয়া রাস্তায় হাঁটিতে হইবে না, যেখানে সামান্য বৃষ্টিতেই এক হাঁটু জল দাঁড়াইয়া যাইবে না, যেখানে বায়ু শ্বাসগ্রহণের যোগ্য হইবে, যেখানে জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নটি প্রশাসন সম্যক গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করিবে। দাবিগুলি অপূরণীয় নহে। কিন্তু, শহরের ইতিহাস সাক্ষী, পুরসভায় বোর্ড পাল্টায়, এক দল ক্ষমতা হইতে সরে, অন্য দলের আবাহন হয়, কিন্তু শহর পাল্টায় না। এখনও ইলেকট্রিকের খোলা লাইনে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হইয়া প্রাণহানি ঘটে এই মহানগরে; একের পর এক বহুতল কার্যত জতুগৃহ হইয়া থাকে, কিন্তু পুর প্রশাসনের কখনও হুঁশ ফিরে না; প্রতি বৎসরই ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গির ন্যায় প্রতিরোধযোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন বহু মানুষ। ফুটপাত জুড়িয়া অবৈধ হকার, এবং রাস্তার অর্ধেক জুড়িয়া বেআইনি পার্কিং পথচারীকে বাধ্য করে বিপদ মাথায় লইয়া পথ চলিতে। ইতস্তত জমিয়া থাকা জঞ্জালের স্তূপ, পথেঘাটে গণ শৌচাগারের অভাব, শতাব্দীপ্রাচীন নিকাশির ভগ্নপ্রায় দশা— প্রাত্যহিক গা-ঘিনঘিনও এই শহরের বাস্তব। নির্বাচন আসে, নির্বাচন যায়, বাস্তব পাল্টায় না।
সমস্যাগুলির সমাধান করা কি অসম্ভব? না। কিছু কিছু সমস্যা চাহিলে আজই সমাধান করিয়া ফেলা যায়, কিছু সমস্যার জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি প্রয়োজন। কিন্তু, সবেরই সমাধান সম্ভব। বেহাল নিকাশি লইয়া প্রশ্ন উঠিলেই পুরসভা জানাইয়া থাকে যে, শহরের ভূগর্ভস্থ নিকাশিব্যবস্থা বহু প্রাচীন, ফলে এই অবস্থা। তাহা সাময়িক অজুহাত হইতে পারে, দীর্ঘমেয়াদি যুক্তি নহে। ভূগর্ভস্থ নিকাশিব্যবস্থার সংস্কার করিতে হইবে। তাহার জন্য সম্যক পরিকল্পনা গ্রহণ পুরসভারই কাজ। অন্য দিকে, নিয়মিত মশকনিধনের ব্যবস্থা করিতে এমন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন নাই, চাই শুধু নিয়মানুবর্তিতা। শহরের বহুতলগুলিকে নিরাপদ করিবার জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর দমকলের পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা; কোথাও যেন কোনও বৈদ্যুতিক তার খোলা অবস্থায় না থাকে, তাহা নিশ্চিত করা— কোনওটির জন্যই বড় অঙ্কের লগ্নি অথবা বিপুল পরিকল্পনার প্রয়োজন নাই। নগরবাসী বিস্মিত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করিতে পারেন যে, তবুও এই কাজগুলি হয় না কেন? শহর কেন অগ্রসর হইতে পারে না?
সময় গড়াইয়া যায়, শহর যথাপূর্বম্ থাকে কেন? তাহার বৃহত্তম কারণটি হইল পুরসভার প্রকৃত কাজের সহিত কর্তাদের রাজনৈতিক ও কায়েমি স্বার্থের বিরোধ। কথাটি কোনও বিশেষ দলের পুরবোর্ডের ক্ষেত্রে নহে, এই মুহূর্তে দেশের অধিকাংশ পুরবোর্ডের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পরিচালনভার যাঁহাদের উপর ন্যস্ত, তাঁহাদের নিকট নাগরিকের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির গুরুত্ব অধিক নহে। হকার সমস্যাটিই যেমন। কলিকাতা শহরটি ধীরে ধীরে হকারনগরীতে পরিণত হইল নিতান্তই রাজনৈতিক কারণে। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের কর্মসংস্থান হয় নাই, ফলে তাঁহাদের ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণার্থে শহরের ফুটপাতগুলিকে বলি দেওয়া হইয়াছিল। সেই ট্র্যাডিশন চলিতেছে। অভিযোগ, সেই জবরদখল ক্ষমতাসীনদের পক্ষে অর্থকরীও বটে— নিয়মিত মোটা অঙ্কের তোলা আদায় করা হইয়া থাকে। ফলে, সমস্যাটির সুষ্ঠু এবং নাগরিকবান্ধব সমাধানের কথা কোনও পুর-প্রশাসনই ভাবে না। পুরসভার নিকট এই রাজনৈতিক সদিচ্ছাই নাগরিকদের সর্বপ্রধান চাহিদা। প্রশ্ন হইল, যে দলই নির্বাচনে জিতিয়া আসুক, তাহাদের নিকট নাগরিকের স্বাচ্ছন্দ্যের প্রশ্নটি অগ্রাধিকার পাইবে কি? সত্যই কি কলিকাতা একটি বিশ্বমানের আধুনিক শহর হইয়া উঠিতে পারিবে?