কেরলের একটি গ্রাম পঞ্চায়েতের সব সদস্য ও আধিকারিক সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁহারা আর ‘স্যর’ বা ‘ম্যাডাম’ বলিয়া সম্বোধিত হইবেন না। পরিবর্তে ব্যবহৃত হইবে তাঁহাদের নাম এবং পদ। পঞ্চায়েতে কাজে আসা সাধারণ মানুষ স্যর বা ম্যাডাম বলিয়া কথা শুরু করিলে তাঁহারাই শুধরাইয়া দিয়া, নাম ধরিয়া ডাকিতে বলিবেন, বয়স বা অভ্যাসের কারণে মানুষের তাহাতে অস্বস্তি হইলে পদ ধরিয়া সম্বোধন করিতে বলিবেন, তাহাতেও না হইলে মালয়ালম ভাষায় ‘দাদা’ বা ‘দিদি’ বলিয়া। কিন্তু আর যাহাই হউক, স্যর বা ম্যাডাম সম্বোধন নহে, উহার সর্বাঙ্গে এক কালের ব্রিটিশ প্রভুত্ববাদের গন্ধ, একুশ শতকের ভারতে তাহা ব্যবহারের কোনও যুক্তি নাই। এর আগে কেরল বিধানসভার স্পিকারও বলিয়াছিলেন, বিধানসভায় বক্তৃতার শুরুতে বিধায়করা যেন ‘স্যর’ না বলিয়া ‘শ্রদ্ধেয় স্পিকার’ বলেন। ‘স্যর’ সম্বোধন মানুষের দীর্ঘলালিত অভ্যাস হইলেও নিতান্ত অগণতান্ত্রিক, ইউরোপ-আমেরিকাতেও সরাসরি পদ ও নাম ধরিয়াই রাষ্ট্রপ্রধান হইতে রাজনীতিবিদ, বিচারপতি, সংস্থার প্রধান প্রমুখকে ডাকিবার রীতি।
ক্ষুদ্র একটি গ্রাম পঞ্চায়েতের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হইবে কি না, তাহাতে বিপুল এই দেশের সার্বিক সম্বোধনচিত্রে আদৌ কোনও ছাপ পড়িবে কি না, তাহা আসল কথা নহে। যে দেশে পঞ্চায়েত হইতে পুরসভা, বিদ্যায়তন, ব্যাঙ্ক, থানা, সরকারি-বেসরকারি অফিস— সর্ব ক্ষেত্রে জগৎ-সংসারের বহুবিধ জরুরি মীমাংসার সূত্রটি টেবিল বা কাউন্টারের ওই পারে বসিয়া থাকা গম্ভীর মানুষটির হাতে, এবং যাঁহার অনুগ্রহ বা অনুকম্পা অর্জনের প্রথম ও প্রধান ধাপটিই হইল গদগদ ভঙ্গিতে ‘স্যর’ বা ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন, সেই দেশের মজ্জাগত অভ্যাস পরিবর্তনে একটি গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্যগণ নিজেরাই আগাইয়া আসিয়াছেন, ইহাই সবিশেষ গুরুত্বের। উহা কেবল ভাষার পটপরিবর্তনের, বা ঔপনিবেশিক শব্দগুচ্ছকে বিদায় জানাইবার ব্যাপার নহে, এই সম্বোধনে নিহিত ক্ষমতার নীতি বা রাজনীতিও। কেরলের উক্ত পঞ্চায়েতটির পদাধিকারীরা ইহাও বলিয়াছেন, ‘স্যর-ম্যাডাম’ সম্বোধন তো নহেই, পঞ্চায়েতে কাজে আসা মানুষ লিখিত আবেদনে ‘বিনীত নিবেদন’ও নহে, বরং ‘দাবি’ জানাইবেন, কারণ গ্রামের জন্য কাজ করিতেই পঞ্চায়েত, গ্রামবাসী তথা মানুষের প্রতিই তাহার দায়বদ্ধতা। পঞ্চায়েত সদস্য বা আধিকারিকরা বরং নত হইবেন মানুষের কাছে, মানুষ তাঁহাদের কাছে ‘স্যর-ম্যাডাম’ ইত্যাদি বলিয়া নত হইবেন কেন?
বোধটি শুভ, সন্দেহ নাই। কার্যকালে তাহা কতখানি বাস্তবায়িত হইবে, তাহাই দেখিবার। সরকার, প্রশাসন বা বিচারব্যবস্থা ঊর্ধ্বতন, নাগরিক অধস্তন; উহারা শাসক ও নিয়ামক, সাধারণ মানুষ কৃপাপ্রার্থীপাত্র, জনমনে এই ধারণাই বদ্ধমূল। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ হইতে এই প্রবণতা চালিত ও পরিবাহিত হইয়া আসিয়াছে, কিন্তু দেশ স্বাধীন হইলেও, সমাজ ও সময় একুশ শতকে গড়াইলেও প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, বাণিজ্য এমনকি শিল্প-সংস্কৃতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তারাও তাহা শুধরাইয়া দেন নাই, বরং ‘স্যর-ম্যাডাম’ সম্বোধনেই তাঁহাদের আত্মগর্ব ও ক্ষমতাযন্ত্রটি পুষ্ট হইয়াছে। মুখের ভাষা কালের নিয়মে পাল্টায়, ক্ষমতার ভাষা পাল্টাইতে বেগ পাইতে হয়। সেই পরিবর্তন শুরু হইবে কি?