জন মেনার্ড কেন্স হয়তো বলিতেন, অতি দীর্ঘমেয়াদে আমরা সবাই অতি মৃত! অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন যে বাজেট পেশ করিয়াছেন, তাহার রূপরেখার পরিধি ঠিক মহাকালের সমান না হইলেও নেহাত কম নহে— সিকি শতাব্দী। সেই দীর্ঘমেয়াদে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগের কথা বলিয়াছেন অর্থমন্ত্রী। তাহার কয় আনা এই অর্থবর্ষের ভাগে পড়িবে, সেই হিসাব এখনও ধূসর। মূলধনি খাতে ব্যয়বৃদ্ধির যে হিসাব অর্থমন্ত্রী পেশ করিয়াছেন, তাহাতেও সংশয়ের অবকাশ রহিয়াছে। যেমন, মূলধনি খাতে খরচ বাবদ রাজ্যগুলিকে যে বিশেষ ঋণ দিবে কেন্দ্র, তাহাই এই বর্ধিত বরাদ্দের প্রায় অর্ধেক। গত বৎসরের বাজেট জুড়িয়া ছিল ‘ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার পাইপলাইন’। এই বৎসর অর্থমন্ত্রী তাহার উল্লেখই করিলেন না। এই বৎসরের আকর্ষণ: প্রধানমন্ত্রী গতিশক্তি প্রকল্প। অবশ্য, পাইপলাইনে যাহা ছিল, এই প্রকল্পেও তাহার একটি বড় অংশ আছে। নাম পাল্টাইল, কিন্তু তাহাতে এই খাতে লগ্নির অভাব পাল্টাইবে কি? শিক্ষা, স্বাস্থ্যে ডিজিটাল পদ্ধতির অধিকতর প্রচলনের কথা বলিয়াছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু, সেই ক্ষেত্রগুলিতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়িয়াছে অতি সামান্য— মূল্যস্ফীতির পরিমাণটি বাদ দিলে উভয় ক্ষেত্রেই বরাদ্দ কার্যত বাড়ে নাই বলিলেই চলে। ডিজিটাল ব্যবস্থা আসিয়া কি এই ঘাটতি দূর করিতে পারিবে?
জোগান-নির্ভর আর্থিক পুনরুত্থানের নীতিটি কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়িতে নারাজ। কিন্তু, যেখানে বাজারে চাহিদার অভাব, সেখানে উৎপাদনে প্রণোদনা দিয়া, অথবা সহজলভ্য ঋণের ব্যবস্থা করিয়া বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব কি? সমস্যাটি সম্বন্ধে অর্থমন্ত্রী বিলক্ষণ অবহিত। বাজেট ভাষণে তিনি বলিলেন যে, সরকারকেই লগ্নির ক্ষেত্রে অগ্রদূতের ভূমিকা লইতে হইবে। এই বাজেটে তাহার লক্ষণও উপস্থিত— গত বাজেটে রাজস্ব খাতে ব্যয়ের অনুপাতে মূলধনি খাতে ব্যয় ছিল মাত্র ১৯.৫%; এই বাজেটে তাহা বাড়িয়া ২৪% হইয়াছে। কিন্তু, তাহার সীমাটিও খুব স্পষ্ট। সরকারের হাতে বিনিয়োগ করিবার মতো টাকা কোথায়? বিলগ্নিকরণের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় হইলে সেই টাকা মূলধনি লগ্নি হইতে পারিত। গত তিন বাজেটের বিলগ্নিকরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় নাই— বর্তমান বাজেটে লক্ষ্যমাত্রাটিই গত বারের এক-তৃতীয়াংশ। ফল যাহা হইবার, তাহাই হইতেছে।
পঁচিশ বৎসর পরে এই বাজেটের কী সুফল ফলিবে, সেই প্রশ্নের উত্তরের জন্য পঁচিশ বৎসর অপেক্ষা করিতে হইবে— কিন্তু, দেশের সম্মুখে এই মুহূর্তে যে সমস্যা, এই বাজেটে তাহার সমাধান নাই। অতিমারির ধাক্কায় বহু মানুষ দারিদ্রের অতলে তলাইয়া যাইতেছেন। চাকুরি নাই, আয় নাই। ফলে, বাজারে চাহিদাও নাই। মানুষের হাতে ক্রয়ক্ষমতা তৈয়ারি করিবার জন্য কোনও পদক্ষেপ অর্থমন্ত্রী এই বাজেটে করিলেন না। সেই অবহেলার একটি বড় উদাহরণ গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প (এনআরইজিএ)। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে এই প্রকল্পে ব্যয়ের সংশোধিত অনুমানের তুলনায় বাজেট বরাদ্দ কমিল ২৫,০০০ কোটি টাকা। যখন দারিদ্র বাড়িতেছে, এবং তাহারও অপেক্ষা দ্রুততর গতিতে বাড়িতেছে অসাম্য, তখন ন্যায় এবং সমতার খাতিরেই সামাজিক খাতে ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন ছিল। তাহাতে জোগান-নির্ভর নীতিরও সুবিধা হইত। বাজারে চাহিদা ফিরিলে স্বভাবতই লগ্নির চাহিদাও বাড়িত। অর্থমন্ত্রী সেই পথে হাঁটিলেন না। মূল্যস্ফীতির আগুনে যখন গরিব মানুষ ঝলসাইয়া যাইতেছেন, তখন গণবণ্টন ব্যবস্থার বরাদ্দও ছাঁটিয়া দিলেন অর্থমন্ত্রী। ড্রোন-নির্ভর, ডিজিটাল ভারতে বুঝি এই মানুষগুলির আর দরকার পড়িবে না। অথবা, মহাকালের হিসাব কষিতে গিয়া অর্থমন্ত্রী বর্তমানকে অবজ্ঞা করিলেন। সেই কাজটি কতখানি হঠকারী হইল, সেই উত্তরের জন্য মহাকালের অপেক্ষায় থাকিবার প্রয়োজন নাই।