আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটল, তা অতি দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু অপ্রত্যাশিত, এমন কথা বলার জো নেই। এমনকি, এই ঘটনাক্রমকে কেউ যদি ‘অনিবার্য’ বলেন, তাঁর মত উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে কোনও এক বহিষ্কৃত ছাত্রনেতার এই অশালীন, উদ্ধত, কদর্য আচরণ দেখে রাজ্যের নাগরিক সমাজ যদি শিউরে ওঠে, তবে সেই শিহরনে আত্মপ্রবঞ্চনাও আছে বইকি। কারণ, এই রাজ্যে বহু দিনই রাজনীতির বাইরে কোনও পৃথক পরিসর নেই— রাজ্যটি এক সর্বগ্রাসী ‘রাজনৈতিক সমাজ’-এ পরিণত হয়েছে। সেই সমাজ নিজের নিয়মে পরিচালিত হয়— তার সঙ্গে সভ্য সমাজের পরিচিত বৈধতার রীতিনীতির সম্পর্ক নেহাতই আপতিক, অনেক সময়েই ক্ষীণ। সেই রাজনৈতিক সমাজের পরিসরে উপাচার্যের কোনও বিশিষ্টতার দাবি থাকে না— সেই পদে আসীন ব্যক্তিও নিতান্তই শাসক দলের কোনও নেতার আজ্ঞাবহ। পরিস্থিতিটির পিছনে রাজনীতির আধিপত্য বিস্তারের দায় বিপুল— সিপিএম নিশ্চিহ্ন হয়েছে, কিন্তু ‘অনিলায়ন’-এর প্রক্রিয়াটি আরও প্রবল, আরও স্থূল। শিক্ষাজীবীদের দায়ও কম নয়। তাঁদের একটি বড় অংশও নিঃসঙ্কোচে এই ব্যবস্থার শরিক হয়েছেন। ফলে, যে বহিষ্কৃত ছাত্রনেতাটি নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে পারে যে, সে ‘গুন্ডামির ভাষা’-য় কথা বলেছে— সে যাঁকে সামনে দেখছিল, তাঁর পদের সনাতন সম্ভ্রম তার কাছে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সেই নেতা তার সামনে দেখেছিল রাজনৈতিক সমাজেরই আর এক প্রতিনিধিকে, যাঁর সঙ্গে বলের ভাষা ব্যবহারে বাধা নেই।
অসীম দুর্ভাগ্য যে, এই বাচিক হিংস্রতার বাইরে অন্য কোনও ভাষা এই ছাত্রনেতা রপ্ত করতে পারেনি। সে উদাহরণমাত্র— বৃহত্তর বঙ্গসমাজও কি আজ আর ভিন্ন কোনও ভাষায় কথা বলতে জানে? এই ছেলেটি— ছেলেগুলি— একাদিক্রমে এই ব্যবস্থার ফল, এবং ব্যবস্থাটির বাহক। এই ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত শেখায় যে, রাজনৈতিক ক্ষমতার সামনে নত হওয়াই ধর্ম। মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ তাঁর কুর্সিটি রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতাকে ছেড়ে দিয়ে পাশের চেয়ারে জোড়হস্ত বসতে পারেন; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা রাজনৈতিক নেতার সাহচর্যে বিগলিত হন; পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তা শাসক দলের স্থানীয় নেতার সামনে বিনীত ছাত্রের মতো বসেন। বঙ্গসমাজ জানে যে, যথাযথ আশীর্বাদি হাত মাথার উপর থাকলে কোনও অন্যায়েরই শাস্তি হয় না। কলেজ শিক্ষিকাকে আঘাত করেও ‘তাজা ছেলে’-র তকমা নিয়ে পার পাওয়া যায়, অধ্যাপকের গালে চপেটাঘাত করলেও শাস্তি হয় না। গিয়াসউদ্দিন নামক আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিষ্কৃত ছাত্রনেতাটি সেই আচরণই করেছে, এই সমাজ যাকে স্বাভাবিকতার মান্যতা দিয়েছে। তাকে ভর্ৎসনা করা জরুরি, তার শাস্তি হওয়াও প্রয়োজন— কিন্তু, এই পাপের সূচনা যে তার হাতে নয়, এই কথাটিও সমান ভাবে বলা জরুরি।
রাজ্যের শাসক পক্ষকেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রধান দায় নিতে হবে। তাঁরা বলতেই পারেন যে, বিষবৃক্ষের বীজটি তাঁরা ক্ষমতায় আসার আগেই বপন করা হয়েছিল— কিন্তু, তাতে দায়টি অস্বীকার করা যাবে না। রাজনৈতিক ক্ষমতার এককে সমগ্র সমাজকে অধিকার করতে চাওয়া, সেই দাপটের সামনে সমস্ত প্রতিষ্ঠান, সমস্ত ব্যবস্থাকে তটস্থ করে রাখার প্রবণতাটি যে তাঁরা দমন করেননি, বরং আরও তীব্র করে তুলেছেন, সেই সত্য অনস্বীকার্য। তাঁদের স্বীকার করতে হবে যে, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কাণ্ডটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তার বীজ লুকিয়ে আছে সর্বগ্রাসী এবং সম্পূর্ণ নীতিহীন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ভয়ঙ্কর প্রবণতায়। পশ্চিমবঙ্গের সমাজ এক অ-পূর্ব বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কিংবা, হয়তো তলিয়েই গিয়েছে।