সপ্তাহে এক দিন স্বাস্থ্যসচিবকে লইয়া এসএসকেএম হাসপাতালে যাইবার সিদ্ধান্ত লইয়াছেন মুখ্যমন্ত্রী। অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, কোনও বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং উৎসাহী হইলে তাহার প্রভাব হয় সুতীব্র। তদুপরি, বিগত দশ বৎসরে রাজ্যবাসী জানিয়া গিয়াছেন যে, ইহাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্টাইল’। প্রশাসনিক বিবিধ কাজে তিনি সক্রিয় ভাবে উপস্থিত থাকিতে পছন্দ করেন, যাহাকে হয়তো গতানুগতিক প্রশাসকের আচরণের সহিত মিলানো যাইবে না। ২০১১ সালে প্রথম বার মুখ্যমন্ত্রী হইবার পরেই বিভিন্ন হাসপাতালে আচমকা পরিদর্শনে গিয়াছিলেন তিনি, এবং কিছু ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত করিয়া মেরামতে উদ্যোগী হইয়াছিলেন। তৃতীয় বার শপথ লইবার পরেও, সাংবাদিক সম্মেলন সারিয়াই শম্ভুনাথ পণ্ডিত এবং পুলিশ হাসপাতালে পৌঁছাইয়াছিলেন তিনি, অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রশাসনের প্রস্তুতি বুঝিয়া লইতে। ফি সপ্তাহে পিজি হাসপাতালে যাইবার উদ্দেশ্যও স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ও পরিস্থিতি লইয়া সামগ্রিক বিশ্লেষণ। স্বাস্থ্য দফতরও মমতাদেবীর অধীন, অতএব এই উদ্যোগের গুরুত্ব কেবল প্রতীকী নহে। দফতরের মন্ত্রী যদি নিয়মিত কাজকর্ম পর্যালোচনার দায়িত্ব লন, তাহা সর্বার্থেই স্বাগত।
সমস্যা অন্যত্র। মুখ্যমন্ত্রিত্বের বিপুল দায়িত্বের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ব্যতীত আরও ছয়টি দফতর তাঁহার দায়িত্বাধীন। ফলে প্রশ্ন উঠিবেই, কোনও একটি দফতরের খুচরা কাজে এতখানি সময় ব্যয় করিবার মতো সময় মুখ্যমন্ত্রীর আদৌ আছে কি? না কি, মানুষের চোখে নিজের দায়িত্ববোধ প্রমাণ করিবার তাগিদে তিনি প্রকৃত দায়িত্বগুলিকে অবহেলা করিতেছেন? প্রশ্নগুলি উড়াইয়া দেওয়ার মতো নহে। এহেন অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীর কর্তব্য যে, তাঁহার অনুপস্থিতিতেও যাহাতে সমগ্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটি মসৃণ ভাবে চলে, তেমন একটি প্রশাসনিক কাঠামো গড়িয়া তোলা। মুখ্যমন্ত্রীর সাপ্তাহিক বৈঠকে যে সকল সমস্যার প্রসঙ্গ উঠিবে, অনুমান করা চলে যে, সেইগুলির সমাধান হইবে অতি দ্রুত গতিতে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী সময় দিতে না পারিলে যদি সেই গতিতে ঢিলা পড়িয়া যায়, তবে উদ্যোগটির উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়। বুঝিতে হইবে যে, মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতির অর্থ শুধু এই মুহূর্তের সক্রিয়তা নহে, তাঁহার তত্ত্বাবধানে সামগ্রিক ভাবে ব্যবস্থাটিকে সারাইয়া তোলা। মেরামতির আসল কাজটিই বাকি রহিয়া গেলে এক্ষণের শ্রমব্যয় বৃথা হইয়া যায়।
সুতরাং, মুখ্যমন্ত্রীর প্রথা-ভাঙা পরিদর্শনের— অকস্মাৎ অথবা নিয়মিত— তাৎপর্যটি গভীরে অনুধাবন করা প্রয়োজন। প্রশাসনিক প্রধান স্বয়ং কোনও কাজের দায়িত্ব হাতে তুলিয়া লইলে তাহা শুধু সেই কারণেই অতি গুরুত্বপূর্ণ নহে— সেই মুহূর্তটি ব্যবস্থাটিকে ঢালিয়া সাজাইবার সূচনাবিন্দুও বটে। অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রী ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে কাজে গতি আনিয়া দিবেন, সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটি সেই সূত্র ধরিয়া তাহা আগাইয়া লইয়া যাইবে। প্রশাসনের অপর সদস্যদের সেই কর্তব্য পালনীয়। মুখ্যমন্ত্রী নিজে যখন পুরা পরিস্থিতি দেখিবেন, তখন তাহার অভিঘাতে অন্যান্য কাজ সারিয়া ফেলা সম্ভব। এবং, মমতাদেবী কাজকর্ম তত্ত্বাবধানের জন্য পিজি হাসপাতালকে বাছিয়া লইয়াছেন, অতএব শুধু সেই স্থলে তৎপরতা দেখা যাইবে, আর অবশিষ্টাংশে প্রদীপের নীচের অন্ধকার বিরাজ করিবে, ইহাও কাম্য নহে। আয়োজনটি সার্বিক— গ্রামে গ্রামে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র হইতে জেলায় জেলায় সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল, সর্বত্রই সংস্কারের লক্ষণ বাঞ্ছনীয়। সকল সমস্যা, স্বভাবতই, মুখ্যমন্ত্রীর গোচরে আনা সম্ভব হইবে না। সামগ্রিক আয়োজনে কিছুই যেন বাদ না পড়ে, উহাও লক্ষ রাখা জরুরি। এমন সুযোগ বারংবার আসে না। স্বাস্থ্যব্যবস্থার দীর্ঘায়ু কামনা করিলে তাহাকে সর্বতো রূপে কাজে লাগাইতে হইবে।