Traditional

লালনের মাটি

দেখিয়া শুনিয়া কেহ বলিতে পারেন, বাংলার সমাজের সম্প্রীতিকে বাঙালি নিজেই ক্রমশ ভুলিতেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২১ ০৪:৩৫
Share:

প্রতীকী ছবি।

তাসা এক আনদ্ধ বাদ্যযন্ত্রবিশেষ। উৎসব-অনুষ্ঠান-শোভাযাত্রায় তাসা বাজিয়া থাকে, উহার ছন্দে উদ্বেল হইয়া উঠে জনতা। ইদানীং পশ্চিমবঙ্গের ভোটপ্রচারেও ইহার বহুল ব্যবহার চোখে পড়িয়াছে। বিশেষত, বিজেপির বহু মিছিল তাসার ধ্বনিতে পাড়া কাঁপাইয়াছে। দিনকয়েক পূর্বে খাস দক্ষিণ কলিকাতার টালিগঞ্জ অঞ্চলে তাসা লইয়া শোভাযাত্রার চিত্র সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছে। দেখিয়া অবশ্য চমকিত হইতে হইল। গৈরিক পথিকগণ কি পথ হারাইলেন, না কি আত্মবিস্মৃত হইলেন? না হইলে ডমরু, ঢাক, ঢোলক, নাকাড়া, দামামা প্রভৃতি ছাড়িয়া তাসা বাছিয়া লইবেন কেন? কথাটি উঠিতেছে এই কারণে যে, বহু অনুষ্ঠানের ব্যবহার্য হইলেও তাসা একটি বিশেষ ধর্মীয় শোভাযাত্রার অনুষঙ্গ বহনকারী— মহরম। নিয়মিত ভাবে মহরমে এই ধ্বনি শোনা যায়, এবং সেই কারণে একটি পরিবেশ তৈরি হয়। যাঁহারা প্রতি পদক্ষেপে পরমত-অসহিষ্ণুতার নিদর্শন রাখিতে চাহেন, ভিন্‌ধর্মকে শত্রু ঠাহরাইয়া তার সপ্তকে প্রচারগান বাঁধেন, ভিন্ন রুচির দলনে যৎকিঞ্চিৎ কুণ্ঠিত হন না, তাঁহারা কী রূপে অপর সংস্কৃতির অভিজ্ঞান এত সহজে আত্তীকরণ করিয়া লইলেন? নিন্দুকে ইহাকে অজ্ঞানতা বলিবে, তবে আশাবাদী ইহার মধ্যেই আশা খুঁজিবেন। সংস্কৃতি বিষম বস্তু, ছাড়াইতে চাহিলে ছাড়ে না।

Advertisement

দেখিয়া শুনিয়া কেহ বলিতে পারেন, বাংলার সমাজের সম্প্রীতিকে বাঙালি নিজেই ক্রমশ ভুলিতেছে। ভুলিতেছে যে, তাহার জীবনযাপনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধর্মের ভাগাভাগি নাই। হিন্দু ছাত্রের মুসলমান শিক্ষক কেবল যত্নে পড়ান না, আদরে মানুষ করিয়া তোলেন। মুসলমান পড়শির চিকিৎসা-সহায়তায় দ্বিধান্বিত হন না হিন্দু নাগরিক। নানা আয়োজনে মিলিয়া যায় দুই সম্প্রদায়; এমনকি ধর্মবলয়েও তাহা ছাপ রাখিয়া যায়। সুন্দরবনের জল-জঙ্গলজীবীরা বনদেবী আর বনবিবিকে ভাগ করিয়া লন। নরেন্দ্রপুরে মুসলমানের রক্তাখাঁ হিন্দুর রতনগাজি হয়। সত্যনারায়ণ আর সত্যপির যেন একই অস্তিত্বের দুই প্রকাশরূপ। ঘুটিয়ারি শরিফে গাজি পিরের দরগায় প্রথম সিন্নি চড়ান, মোমবাতি জ্বালেন বারুইপুরের রায়চৌধুরী বাড়ির মেয়েরা। এমনই যূথবদ্ধ যাপন জড়াইয়া থাকে বঙ্গদেশের অজগ্রামের জীবন, লোকায়ত সংস্কৃতি। তবে কি বিভাজন বা ঘৃণার যে চিত্রগুলি উঠিয়া আসে, তাহা সত্য নহে? সত্য হইলেও তাহাই একমাত্র, বা প্রধান চিত্র নহে। নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক দুর্বৃত্ত বারংবার কিছু কদর্য ভাবনা ও কু-অভ্যাসকে পাথেয় করিবার চেষ্টা চালাইয়াছে, প্রচারও করিয়াছে, কিন্তু শেষাবধি প্রেমের সংহতির নিকট পরাজিতও হইয়াছে। এই সংহতির বাস দৈনন্দিন যাপনেই, নাগরিক দৃষ্টির আড়ালে।

সম্ভবত, ধর্ম, অর্থাৎ যাহা ধারণ করিতে পারে, তাহা এক ধরনের বাস্তব ঐক্যও সন্ধান করিতে পারে। ভেদাভেদের কানুন দিয়া বিচ্ছেদ ঘটানোই তাহার একমাত্র কাজ নহে, কাছাকাছি আনিবার চেষ্টা করাও তাহার কাজ। এই সর্বজনীন পারস্পরিক নির্ভরতার সূত্রেও ধর্ম রচনা করা যায়, এই ভাবে বাংলায় ধর্ম রচিত হইয়াছে। উত্তরপ্রদেশ কিংবা মধ্যপ্রদেশে নহে, বঙ্গেরই লোককবি বলিয়াছিলেন, প্রতিবেশীর স্পর্শে নাকি যম-যাতনা দূরীভূত হয়। এই মৃত্তিকা সেই লালনের। লালন সাঁইয়ের, লালন-পালনেরও।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement