Central Government

ব্যর্থতা

লোকসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, যেটুকু আস্থা ছিল, তাতে আরও চিড় ধরছে। যেমন, নির্বাচনী বন্ডের পরিসংখ্যান প্রকাশ্যে আসায় দেখা গেল, রাহুল গান্ধী যে প্রাতিষ্ঠানিক তোলাবাজির অভিযোগ করেছেন, সেটি সারবত্তাহীন নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৪ ০৭:১৮
Share:

— ফাইল চিত্র।

সরকার যা করে, তাকেই যদি অবিশ্বাসের চোখে দেখতে হয়, তা হলে ভারী মুশকিল। দেশবাসী সেই মুশকিলেই পড়েছেন। বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিতান্তই অভিজ্ঞতার উপরে নির্ভরশীল। কেউ যদি অতীতে নিরন্তর মিথ্যা বলে থাকেন, এবং সেই মিথ্যা ধরা পড়ে গিয়ে থাকে, তা হলে তাঁর কথা বর্তমানেও বিশ্বাস করা মুশকিল হয়। গত দশ বছরে কেন্দ্রীয় সরকার যত কথা বলেছে, তার একটি বড় অংশ ইতিমধ্যেই ভিত্তিহীন হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। বৃহত্তম উদাহরণ, বিমুদ্রাকরণ। কালো টাকাও কমেনি, নগদের ব্যবহারও কমেনি— শুধু যে ডিজিটাল ওয়ালেট সংস্থাটি তাদের বিজ্ঞাপনে প্রধানমন্ত্রীর ছবি ব্যবহার করেছিল, সম্প্রতি তাদের ব্যবসার ভিটেমাটি চাঁটি হয়েছে। সাম্প্রতিকতর উদাহরণ দিতে গেলে ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার ভুয়ো প্রতিশ্রুতিটির কথাও বলা যায়। অথবা, নিতান্ত জনসংখ্যার মাহাত্ম্যে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থব্যবস্থা হয়ে ওঠার ঘটনাটিকে যে ভঙ্গিতে নেতারা ব্যবহার করছিলেন, বলা যায় তার কথাও। মোটমাট, বিশ্বাস বজায় রাখার পথ সরকারই খোলা রাখেনি। লোকসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, যেটুকু আস্থা ছিল, তাতে আরও চিড় ধরছে। যেমন, নির্বাচনী বন্ডের পরিসংখ্যান প্রকাশ্যে আসায় দেখা গেল, রাহুল গান্ধী যে প্রাতিষ্ঠানিক তোলাবাজির অভিযোগ করেছেন, সেটি সারবত্তাহীন নয়। এই অবস্থায় এ কথা বিশ্বাস করাও কি কঠিন নয় যে, দিল্লিতে যে ভঙ্গিতে অরবিন্দ কেজরীওয়ালকে গ্রেফতার করা হল, তা কেন্দ্রীয় তদন্তকারীর সংস্থার অপব্যবহারের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা ভিন্ন আর কিছু নয়? দেশে গণতন্ত্র চলছে, এ কথা বিশ্বাস করার রাস্তা কি কেন্দ্রীয় শাসকরা খোলা রেখেছেন?

Advertisement

প্রশ্ন হল, এই সুগভীর অবিশ্বাস কি জনমানসে যথেষ্ট পরিমাণে কিংবা আদৌ প্রতিফলিত হচ্ছে? আপাতদৃষ্টিতে এই প্রশ্নের একটিই উত্তর— না। সরকারের উপর দেশবাসীর আস্থা এখনও দৃশ্যত অটুট। গণতন্ত্র সঙ্কটাপন্ন হলেও সাধারণ মানুষ গোড়ায় বিশেষ বিচলিত হন না, এই কথাটির প্রমাণ দুনিয়া জুড়ে রয়েছে— তুরস্ক বিষয়ে সাংবাদিক এচে তেমেলকুরানের বইয়ের কথা মনে পড়তে পারে। ভারতেও লেখা হয়েছে কী ভাবে জরুরি অবস্থায় গণতান্ত্রিক অধিকার খণ্ডিত হওয়ায় বিচলিত হওয়ার পরিবর্তে অনেক মানুষই খুশি হয়েছিলেন যে, সব ট্রেন সময়ে চলছে! কিন্তু, অর্থনীতির আঁচ সরাসরি মানুষের গায়ে লাগে। যে দেশে আর্থিক অসাম্য এমন প্রবল, নিরপেক্ষ বিশ্লেষকদের হিসাবে যে দেশে প্রতি পাঁচ জনে এক জন এখনও দারিদ্রসীমার নীচে, সেই দেশ যে অর্থনৈতিক শক্তিতে জাপান বা জার্মানির ধারেকাছেও পৌঁছতে পারে না, এ কথাটি বুঝে মানুষের অবিশ্বাস জন্মানোর কথা। তাও যখন ঘটে না, কী ভাবে তা ব্যাখ্যা করা যায়?

একটি ব্যাখ্যা হতে পারে, সর্বনাশ ঘটে গেলে, সেই সর্বনাশের মধ্যে বসে সাধারণ মানুষের পক্ষে তা টের পাওয়া কঠিন। নিজের মন্দ থাকাকে মানুষ নিজের দোষ বা ব্যর্থতা হিসাবে মেনে নিতে শুরু করে, বিশেষত সেই জমানায়, যেখানে দেশের প্রধান শাসককে প্রতিষ্ঠিত করা হয় অতিমানবিক মহিমায়। এখানেই প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির কাজ। শাসক-উবাচ প্রতিটি মিথ্যাকে চিহ্নিত করে, তাকে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিকতার সঙ্গে জোড়া যায় এমন ভাষায় ও ভঙ্গিতে বারংবার জনসমক্ষে নিয়ে আসার দায়িত্বটি বিরোধী রাজনীতি কোনও অবস্থাতেই অস্বীকার করতে পারে না। প্রসঙ্গত দৃষ্টান্ত, প্রাক্‌-২০১৪ পর্বে মূল্যস্ফীতির সমস্যাটিকে বিজেপি প্রতীকায়িত করেছিল গ্যাসের সিলিন্ডারের মাধ্যমে। এমন একটি সামগ্রী, যার মূল্যবৃদ্ধি উদ্দিষ্ট ভোটারবর্গকে তুমুল বিচলিত করে। বিরোধী রাজনীতি এই কাজটি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। শাসকরা কোথায় সত্যকে বিকৃত করছেন, কোথায় অর্ধসত্যের জাল বুনছেন, এই কথাটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেই পারেনি। এমন বিরোধী থাকলে ‘জনগণের আস্থা’ নিয়ে ভাবতে হয় না।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement