—প্রতীকী চিত্র।
লঙ্কায় যে যায় সে-ই রাবণ হয় কি না, তা হয়তো তর্কসাপেক্ষ, কিন্তু একটি সিদ্ধান্ত ক্রমশ তর্কাতীত হয়ে উঠেছে: বিজেপিতে যে নেতাই যাবেন, তিনিই হয়ে উঠবেন প্রবল নারীবিদ্বেষী। তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন তমলুকের বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, পূর্ব মেদিনীপুরের নির্বাচনী জনসভা থেকে যিনি তাঁর রাজনৈতিক বিরোধী, তৃণমূল প্রধান তথা মুখ্যমন্ত্রীর ‘বিক্রি হওয়ার দাম’ নিয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন। কথার পিঠেই শুধু নয়, কথার ভাঁজেও নানান কথা লুকিয়ে থাকে, শব্দের নির্বাচন, প্রয়োগ, শরীরভঙ্গিতেও ছুড়ে
দেওয়া যায় বিদ্বেষের বিষ। বিজেপি প্রার্থীর ভাষণে তৃণমূলের দুর্নীতির চাঁছাছোলা অভিযোগের ধারটা তিনি নিজেই ভোঁতা ও আত্মঘাতী করে তুললেন নিজের ভাবে ও ভাষায়। নির্বাচনী আদর্শ আচরণবিধি ভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি শোকজ় নোটিস ধরিয়েছে, তাঁর দলও বেগতিক দেখে হেভিওয়েট প্রার্থীর কুরুচিকর মন্তব্যকে ‘নিতান্ত ব্যক্তিগত’ বলে সাফাই গাইছে। ‘ব্যক্তিগত’ অংশটিই অবশ্য আলাদা করে ভাবিয়ে দেয়, ব্যক্তিটি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলে। এই সে দিন পর্যন্তও এই ব্যক্তিই এমন এক পেশাজগতে ছিলেন যেখানে বাস্তববোধ, নৈতিক ব্যবহার ও কাণ্ডজ্ঞান প্রথম ও শেষ কথা। কোন সময় কোন শব্দটি বলতে হবে, কোনটির উচ্চারণ অসাংবিধানিক, অনৈতিক বা অমানবিক, সেই বোধ ও অভ্যাস যেখানে তাঁর অনায়াস করায়ত্ত থাকার কথা। এই কি তাঁর নিজস্ব শিক্ষা ও সংস্কৃতি? না কি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে, প্রতিপক্ষের বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি সম্পূর্ণ ‘হারিয়ে’ ফেলেছেন নিজেকে? জেনেশুনে পার্টিলাইন মেনে আচরণ করছেন— বিজেপিরই মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে এত কাল হেঁটেছেন, সেই পথে হেঁটে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেতে চাইছেন?
রাজনীতিতে নেতাদের অকথা-কুকথা বলার রীতি আজকের নয়, কিন্তু বিজেপির হাতে তা এক অতল স্পর্শ করেছে। গত দশ বছরের শাসনে তাদের নেতা-মন্ত্রীরা ঘৃণাভাষণ ও বিদ্বেষবচনের প্রবণতাটি অভ্যাসে পরিণত করেছেন। বেশির ভাগ সময়েই এই ঘৃণা ও বিদ্বেষের উদ্দিষ্ট নারী, জাতি ধর্ম পেশা অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে— বিরোধী নেত্রী, অভিনেত্রী, লেখিকা, নারী-সমাজকর্মী, নারী-সাংবাদিক, দলিত নারী, সংখ্যালঘু নারী, কর্মজীবী শ্রমজীবী নারী। নারীবিদ্বেষের প্রদর্শনীতে শামিল খোদ প্রধানমন্ত্রীও, নরেন্দ্র মোদীর কুৎসিত ইঙ্গিত ও সুর খেলিয়ে ‘দিদি’ উচ্চারণ, কংগ্রেসের বিরোধিতা করতে গিয়ে ‘কংগ্রেস কি বিধবা’-র মতো শব্দপ্রয়োগ যখন নন্দিত হয়, প্রজ্বলের মতো আতঙ্কজনক নারী-নির্যাতনকারী ব্যক্তিদের যখন প্রার্থী করা হয়, বিজেপির নারীদর্শনটি হাট হয়ে পড়ে। তাদের মুখে নারীশক্তির বড় বড় বুলি, আর কাজে— নারী হেনস্থা, নির্যাতন, ধর্ষণ ও খুনে অভিযুক্ত নেতা-মন্ত্রীদের আগলে রেখে, ভোটের টিকিট দিয়ে, দলিত বা সংখ্যালঘু নারীর গণধর্ষণকারীদের প্রকাশ্যে এবং সসম্মানে বরণ করে নারীবিদ্বেষের ঘরানা তৈরির ধারাবাহিকতা।
তবে, বিজেপিকে একা দোষী ভাবা মুশকিল, যখন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়রা পাশেই আছেন। ভোটের আগে জ্বালাময়ী ভাষণ কিছু নতুন কথা নয়; প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণ বা শ্লেষও নতুন নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে দেখা যাচ্ছে, গাত্রদাহ, আক্রমণ ও শ্লেষের মাত্রা ছাড়ানোই এখন রাজনীতির প্রিয়তম প্রকরণ। যেন নতুন একটি পথ তৈরি হচ্ছে— নৈতিক অবনমনের পথ। অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সেই পথে একটি মাইলফলক তৈরি করলেন। আরও একটি করলেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বাম প্রার্থী দীপ্সিতা ধরের গাত্রবর্ণ নিয়ে কটাক্ষ করে। বাংলার রাজনীতির এই অতীব দুর্ভাগ্যজনক মান এ বারের লোকসভা নির্বাচনী প্রচারের একটি ‘বিশেষ প্রাপ্তি’। নাগরিক সমাজকেই ভাবতে হবে, এই মানের নেতাদের নিয়ে তাঁরা কী করবেন।