—প্রতীকী ছবি।
ঘনঘোর বর্ষা নিয়ে অধুনা পশ্চিমবঙ্গবাসীর মনে কাব্যভাব কমই জন্ম নেয়। বর্ষা মানেই জল জমা, বিপর্যস্ত নিকাশি। এবং বর্ষা মানেই মশাবাহিত রোগ। বস্তুত, গত বছর ডেঙ্গি নিয়ে শহর কলকাতা এবং সংলগ্ন অঞ্চলে যেমন আতঙ্ক ছড়িয়েছিল, তেমনটির নজির খুব বেশি পাওয়া যায় না। আক্রান্তের সংখ্যা তো বটেই, রেকর্ড গড়েছিল মৃতের সংখ্যাও। এই বছর তার পুনরাবৃত্তি আটকাতে অন্তত খাতায়-কলমে তৎপর প্রশাসন। কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম যেমন নগরপালকে লেখা চিঠিতে থানার সামনে রাখা পরিত্যক্ত গাড়িগুলি দ্রুত সরিয়ে ফেলতে অনুরোধ করেছেন। ডেঙ্গির জীবাণুবাহক মশার বংশবিস্তারের পছন্দসই ক্ষেত্রগুলির মধ্যে পরিত্যক্ত গাড়ি এবং টায়ার অন্যতম। সুতরাং, আঁতুড়ঘরগুলিকে ধ্বংস করা হলে তার বংশবিস্তারের কাজটি ব্যাহত হবে। সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়াকে নিয়ন্ত্রণ করাও সহজ হবে।
অবশ্য, গত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত মার্চে নবান্নের একটি বৈঠকে বলা হয়েছিল, গ্রামে এবং শহরে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য অতিরিক্ত লোক নিয়োগ করা হবে, যাঁরা প্রতি বাড়িতে ঘুরে জীবাণু নিয়ন্ত্রণের কাজও করবেন। রাজ্যের ৬০টি সরকারি এবং পুর হাসপাতালে ডেঙ্গি পরীক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে, মশার লার্ভা যাতে না জন্মায় তার জন্য খাল সংস্কার করা হবে, বর্ষার আগে বন্ধ কারখানা চত্বর, সরকারি দফতর, বাস ডিপো, আবর্জনা স্তূপ প্রভৃতি জায়গা পরিষ্কার এবং সেগুলিতে নজরদারি করা হবে ইত্যাদি। সিদ্ধান্তগুলি ইতিবাচক। কিন্তু ডেঙ্গির মতো বিপজ্জনক রোগের হাত থেকে পরিত্রাণ তখনই মেলে, যখন সর্ব স্তরের মধ্যে সমন্বয়ের কাজটি সুসংগঠিত হয়। প্রতি বছরই বিভিন্ন বৈঠকে ডেঙ্গি দমনের জন্য এই পদক্ষেপগুলিই নানা ভাবে চর্চায় উঠে আসে। অথচ, সংক্রমণের মরসুম শুরু হলে আক্রান্তের সংখ্যায় রাশ টানা যায় না। অতএব, ধরে নেওয়া যায় যে, সমন্বয়ের কাজটিতে বড় ধরনের কোনও গোলমাল আছে। অথবা পদক্ষেপগুলি শুনতে যতটা আকর্ষণীয়, প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাতে ফাঁক থেকে যাচ্ছে। সুতরাং, এই মরসুমে ‘কী করা উচিত’-এর সঙ্গেই এ-যাবৎ কাল যা করে আসা হয়েছে, তার ত্রুটিগুলি খোঁজাও সমান প্রয়োজনীয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় গাঙ্গেয় বঙ্গের আবহাওয়া যে ভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, তাতে চিরাচরিত ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার মরসুমকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। এই রোগ এখন প্রায় সারা বছরের সঙ্গী। তাই সারা বছরই প্রতিরোধের কাজটি সমান গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা উচিত। নির্দিষ্ট ভাবে পতঙ্গবাহিত রোগ প্রতিরোধের কাজে প্রশিক্ষিত কর্মী-বাহিনী নিয়োগ করা প্রয়োজন। লক্ষণীয়, এই বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দার্জিলিঙে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড গড়েছে, যা যথেষ্ট চিন্তার। ডেঙ্গি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলি বিবেচনায় আনা হচ্ছে কি? মশাবাহিত রোগের পরিবর্তিত চরিত্র বুঝতে যে পরিমাণ গবেষণাগার দরকার, যত জন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা দরকার, সেই কাজই বা কত দূর অগ্রসর হয়েছে? সংক্রমণ প্রতিরোধের কাজটি যেন নিশ্ছিদ্র হয়, সেই দিকে সরকারকে সর্বাগ্রে নজর দিতে হবে। অন্যথায়, প্রতি বর্ষার আগে পরিত্যক্ত গাড়ি, চায়ের কাপ, ডাবের খোলার গল্প শুনিয়ে মশাকে থামানো যাবে না।