৪৯টি দেশে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছেন দুর্ভিক্ষের খাদের কিনারে। প্রতীকী ছবি।
রোজ রাতে ৮২ কোটির বেশি মানুষ অভুক্ত অবস্থায় ঘুমোতে যান। রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম-এর পরিসংখ্যান থেকে বেরিয়ে এসেছে এই ভয়ঙ্কর ছবি। অতিমারির দু’বছর দুনিয়াকে দাঁড় করিয়েছে প্রবল ক্ষুধার সামনে— ২০১৯ সালে, অতিমারি আরম্ভ হওয়ার অব্যবহিত আগে, গোটা দুনিয়ায় সাড়ে তেরো কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার তীব্র অভাবে ভুগতেন; বর্তমানে সংখ্যাটি তার প্রায় তিন গুণ, সাড়ে চৌত্রিশ কোটি। ৪৯টি দেশে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছেন দুর্ভিক্ষের খাদের কিনারে। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম এই বিপুল ক্ষুধার যে কারণগুলি নির্দেশ করেছে, তার প্রথমটি যুদ্ধ ও রাজনৈতিক অশান্তি; দ্বিতীয়টি বিশ্ব উষ্ণায়ন; তৃতীয় কোভিড অতিমারি; এবং চতুর্থ কারণ হল খাদ্যপণ্যের বর্ধিত দাম। সত্য যে, এ বছর খাদ্যের জোগান কমেছে, উৎপাদনও ব্যাহত হয়েছে— কিন্তু, মূলত ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এই সঙ্কটকে তীব্রতর করেছে। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সঙ্কটের ফলে সারের দাম বেড়েছে বিপুল ভাবে, জ্বালানির খরচ বাড়ায় পরিবহণ ব্যয়ও বেড়েছে— ফলে, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধও খাদ্যের বাজারে বিধ্বংসী প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বের মোট গম রফতানির ২৭% আসত রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। ভুট্টা, সূর্যমুখী ফুলের বীজ ইত্যাদির জোগানও প্রবল ভাবে ব্যাহত হয়েছে। যুদ্ধ পরিস্থিতি কার্যত নিশ্চিত করেছে যে, আগামী অর্থবর্ষেও এই সঙ্কট বজায় থাকবে। পাশাপাশি রয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব— বর্ধিত তাপপ্রবাহ, বন্যা এবং খরার ফলে খাদ্য উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছে বিপুল। একটি গবেষণা জানাচ্ছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি দশকে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ দুই থেকে ছয় শতাংশ অবধি কমতে পারে। অন্য একটি গবেষণা বলছে, ১৯৬৪ থেকে ১৯৯০ অবধি সময়কালে জলবায়ুগত কারণে যেখানে বছরে গড়ে ২.২ শতাংশ খাদ্যশস্য নষ্ট হত, ১৯৯১-২০১৫ অবধি সময়কালে সেখানে বছরে নষ্ট হয়েছে ৭.৬ শতাংশ ফসল। এ ছাড়াও, কোভিড-লকডাউনের ফলে আন্তর্জাতিক জোগান শৃঙ্খল বিপর্যস্ত হওয়ার প্রভাব পড়েছে খাদ্যশস্যের জোগানে, এবং ফলস্বরূপ, তার দামে।
এই বিপুল ক্ষুধা স্বভাবতই রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ হয়েছে। গত মে মাসে ইরানে গমের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে বিপুল বিক্ষোভ হয়েছিল। আফ্রিকার বহু দেশ খাদ্যের জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেনের রফতানির উপর বিপুল ভাবে নির্ভরশীল— সেই দেশগুলিতেও জনরোষ ক্রমে বিপজ্জনক আকার ধারণ করছে। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝানোর জন্য অনতিঅতীতের উদাহরণ টেনেছে। টাকার অভাবে ২০১৫ সালে সংগঠনটি সিরিয়ার উদ্বাস্তুদের জন্য খাবারের জোগান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হওয়ার পরই ইউরোপের ইতিহাসে বৃহত্তম উদ্বাস্তু সঙ্কট তৈরি হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের মত, যে অনুন্নত দেশগুলিতে খাদ্যসঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করছে, তাদের যদি সেই সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার মতো সামর্থ্য জোগানো না যায়, তবে আবার উদ্বাস্তু সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। নিয়তির কী বিচিত্র পরিহাস! মানবসভ্যতার ইতিহাসে একবিংশ শতাব্দীর মতো সমৃদ্ধ সময় আগে কখনও আসেন, অথচ সেই সময়েই বিশ্বের প্রতি দশ জন মানুষের মধ্যে এক জনকে অভুক্ত অবস্থায় রাত কাটাতে হচ্ছে, নিছক খাদ্যভাব মানুষকে দেশান্তরি হতে বাধ্য করবে বলে আশঙ্কা তীব্র হচ্ছে! এই বৈশ্বিক সমস্যার আশু সমাধানের জন্য সব দেশকে এক সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে, টাকার সংস্থান করতে হবে। ধনী, শিল্পোন্নত দেশগুলিকে স্বাভাবিক ভাবেই অধিকতর দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু, তা সুস্থায়ী সমাধানসূত্র নয়। এক দিকে পরিবেশ রক্ষায় সর্বশক্তিতে চেষ্টা করতে হবে, অন্য দিকে বন্ধ করতে হবে রাজনৈতিক অস্থিরতাও।