— ফাইল চিত্র।
গার্ডেনরিচের বাসিন্দারা সচেতন না হলে, এই এলাকা গ্যাস চেম্বারে পরিণত হবে— কথাগুলি বলেছিলেন কলকাতার মাননীয় মেয়র ফিরহাদ হাকিম। এক বার নয়, একাধিক বার। যে অভিযোগগুলির উত্তরে তাঁর এ-হেন প্রতিক্রিয়া, তার প্রত্যেকটিই ছিল খোদ মেয়রের খাসতালুকে একের পর এক বেআইনি বহুতল নির্মাণ সংক্রান্ত। অর্থাৎ, আইন যে নির্বিচারে ভাঙা হচ্ছে, যে কোনও অঘটন সময়ের অপেক্ষামাত্র, তা জানত পুর-প্রশাসনের শীর্ষ স্তর। তবুও সেই অঘটন ঘটল। রবিবার মধ্যরাতে সেই গার্ডেনরিচেই নির্মীয়মাণ বহুতল ভেঙে বেঘোরে মারা পড়লেন ন’জন। আহত বহু। এবং দুর্ঘটনার সঙ্গেই যে প্রশ্নগুলির উত্তর ধ্বংসস্তূপের আড়ালে সম্ভবত চিরতরে চাপা পড়ে গেল, তা হল— এত দিন ধরে খাস কলকাতা শহরে পুর-প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া ন্যূনতম নিয়মবিধি না মেনে একের পর এক নির্মাণকার্য চলল কী ভাবে? যে কাজের উপর অনেকগুলি মানুষের বেঁচে থাকা জড়িয়ে, সেখানে শুধুমাত্র বাসিন্দাদের সচেতনতার উপর আস্থা রেখে দেওয়া কি নিতান্তই নির্বুদ্ধিতার পরিচয় নয়? দেশের এক ‘প্রথম সারি’র শহরের পুর-প্রশাসনের পক্ষে সেই নির্বুদ্ধিতার প্রদর্শন কি আদৌ মানানসই?
প্রশ্ন তোলা যায় প্রশাসনের অন্য স্তরগুলির আশ্চর্য নীরবতা নিয়েও। বেআইনি নির্মাণ প্রসঙ্গে সম্প্রতি মেয়র জানিয়েছেন, বেআইনি নির্মাণ ওয়ার্ডে কোথায় কত হচ্ছে, তা নজরে রাখা কাউন্সিলরের কাজ নয়। খাতায়-কলমে হয়তো কথাটিতে ভুল নেই। স্থানীয় নির্মাণে অনুমোদন দেওয়ার দায়িত্ব পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের, যে কাজে তারা ডাহা ফেল বললে অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু প্রসঙ্গ যেখানে ওয়ার্ডের মানুষদের নিরাপত্তা, সেখানে দৃশ্যত বিপজ্জনক নির্মাণ দেখে কাউন্সিলর আপত্তিটুকু জানালেন না কেন, সেই প্রশ্ন তোলা নিরর্থক নয়। কারণ, বহুতল ভাঙলে আশপাশের বাড়ি ও বাসিন্দাদেরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সমান সম্ভাবনা। তা ছাড়া পুরসভার অনুমতি ছাড়াই নির্মাণকার্য চললেও একই রকম নিষ্ক্রিয় থেকেছে পুলিশ। গার্ডেনরিচের দুর্ঘটনার পর লালবাজারের কর্তারা শহরের অন্যত্র বিধি মেনে বহুতল নির্মাণ হচ্ছে কি না, থানাগুলিকে নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে বেআইনি বহুতলের সন্ধান পেলে সংশ্লিষ্ট পুরসভাকে জানাতে বলা হচ্ছে। এই তৎপরতা আরও আগে নেওয়া গেলে, এতগুলি অকালমৃত্যুর সাক্ষী হতে হত না এ শহরকে। অবশ্য, নীরবতার কারণটিও সহজবোধ্য। এই রাজ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতাবিন্যাস এমনই যে, উপরমহল থেকে বেআইনি কাজের অনুমোদন মিললে তার ‘বিরোধিতা’র দুঃসাহস কেউ দেখাতে পারেন না। এই কারণেই অসাধু প্রোমোটার চক্র ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠবৃত্তে নাম লেখায়, নেতাদের কল্যাণহস্ত ধরে রাখতে নিয়মিত তাঁদের ‘সন্তুষ্ট’ রাখার ব্যবস্থা করে।
এই চিত্র শুধু গার্ডেনরিচের নয়। কলকাতার বিভিন্ন কোণে পুরসভার অনুমতি ছাড়াই অসংখ্য বেআইনি নির্মাণ বিপদের সম্ভাবনা মাথায় নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে। দুর্ঘটনা ঘটলে কিছু ফাঁপা আশ্বাস আর পূর্বের জমানাকে দোষারোপ ব্যতীত কিছুই পড়ে থাকে না। স্থানীয়দের আপত্তি, অবরোধে নির্মাণকাজ বন্ধ হলেও অনতিবিলম্বে অন্যত্র ফের তা মাথাচাড়া দেয়। ফের রাজনীতি মেশে সেই অসাধু বৃত্তে। আর এ শহর অপেক্ষায় থাকে আরও এক মৃত্যুমিছিলের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার জন্য।