—ফাইল চিত্র।
গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতা জরুরি বিষয়। অত্যন্ত বিপজ্জনক বিষয়ও বটে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ক্ষমতার আধিপত্য কায়েম করতে চাওয়া গণতন্ত্রবিরোধিতার পর্যায়ে পড়ে। গণতন্ত্র নামক ব্যবস্থায় শাসক হিসাবে ক্ষমতা পাওয়ার একটি গুরুতর দায় ও দায়িত্ব বিরোধীদের কথা শোনা, বিবেচনা করা, এবং তার গুরুত্ব অনুযায়ী সিদ্ধান্তে পৌঁছনো— যে ভারসাম্য ভারতীয় বাস্তবে খুব কম সরকারকেই রক্ষা করতে দেখা যায়। সাড়ে তিন দশকের বামশাসিত ও চতুর্দশ বর্ষে পদার্পণকারী তৃণমূল কংগ্রেসশাসিত পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাদের সে কথা মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। লক্ষণীয়, এ-হেন ভারতবর্ষেও, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার যে বাহুবল-প্রদর্শনী চালিয়ে যাচ্ছে প্রায় এক দশক ধরে, তা, এক কথায়, অ-দৃষ্টপূর্ব। একের পর এক আইন পাশ হয়েছে বিরোধীদের মতামতের অপেক্ষা না করে, কিংবা বিরোধী বক্তব্যকে উপেক্ষা করে। প্রচলিত ভারতীয় ফৌজদারি আইনবিধির জায়গায় দণ্ডসংহিতা— ন্যায়সংহিতা, নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা ও সাক্ষ্য অধিনিয়ম নিয়ে বিল পেশ করেই তা স্থায়ী কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সৌজন্যে: যে পদ্ধতির মধ্যে সেই একই পরিচিত ও অপরিমিত ক্ষমতান্ধতার প্রকাশ। সজোরে বলা দরকার, এই ভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে অগ্রসর হওয়া কেবল অন্যায় নয়, সম্পূর্ণত অগণতান্ত্রিক।
এই যদি হয় পদ্ধতির কথা, বিধির বিষয়টি খতিয়ে দেখলে আপত্তি দাঁড়াবে সজোরতর। অনেক গুরুতর বিষয়ে আলোচনা অতি আবশ্যক ছিল, সেই আলোচনার সূত্রপাতও হয়েছিল, কিন্তু ‘তাড়াহুড়ো’র চোটে তা থামিয়ে দিতে হল। তাড়াহুড়ো, কেননা আগামী শীতকালীন অধিবেশনেই নাকি ওই তিনটি বিল আনতে হবে। অক্ষমণীয় এই তাড়ার দৃষ্টান্ত হিসাবে মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। এই দণ্ড চালু রাখা উচিত কি না, তা নিয়ে যে কোনও সভ্য, উন্নত গণতন্ত্রেই বিতর্ক আছে। ন্যায়সংহিতার প্রসঙ্গে সংসদে সেই তর্ক তুলেছিলেন কংগ্রেস নেতা ও প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম। কিন্তু ‘সময়াভাব’ সেই তর্ক থামিয়ে দিল। বরং শোনা গেল শাসক পক্ষের তর্জন, জঙ্গিদের প্রতি নরম মনোভাবের কারণেই প্রাক্তন মন্ত্রীর এই আপত্তি। প্রসঙ্গত, চিদম্বরমকে বিশেষ ভাবে জঙ্গিপ্রেমী মনে করা অসম্ভব: রাজনীতি-সচেতন ভারতীয় মাত্রেই তা জানেন। অথচ বাদানুবাদটুকুরও স্থান রইল না সংসদে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন অবশ্য রাষ্ট্রবিরোধিতার ঔপনিবেশিক আইনগুলি নিয়ে, যে আইন স্বাধীন দেশের নাগরিকের প্রতি ব্যবহৃত হওয়া যে অন্যায় সে কথা বার বার বিরোধীদের বক্তব্যে উঠে এসেছে গত এক দশকে। তবু এই অকারণ কঠোর আইনসমূহের পক্ষে শাসক দল কেবল সরব নয়, অত্যুৎসাহী। বিরোধীদের কোনও প্রশ্ন তাদের কাছে গ্রাহ্য নয়। এই ভাবেই আজ সংখ্যার দাপটের কাছে পরাভূত হচ্ছে সমস্ত তর্ক, তত্ত্ব, যুক্তি। ভারতীয় ‘গণতন্ত্র’ আজ নিজেকে এখানেই অবনমিত করেছে— আর তার পিছনে অবশ্যই রয়েছে ভারতীয় নাগরিকের নির্বিকার স্নেহাশিস সিঞ্চন।
এবং এই পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রকট উত্তর ভারতের হিন্দি বলয় মানসিকতার এক তীব্র প্রতিফলন। কেন আইনবিধির নাম থেকে শুরু করে সমস্ত পরিভাষা হিন্দিতে ভাষান্তরিত হচ্ছে— তার যুক্তি অজানা। হিন্দি ভারতের অন্যতম প্রধান ভাষা হতে পারে, ‘জাতীয় ভাষা’ নয়। এ দেশের বহু অংশে হিন্দি আদৌ গ্রহণযোগ্যই নয়। তা হলে কেন এই অহেতুক ও অনৈতিক হিন্দিত্ব-বাদ? তামিলনাড়ুর মুখ্যামন্ত্রী স্ট্যালিন এই দণ্ডসংহিতার বিষয়টিকে ভারতের পুনরুপনিবেশকরণ (রি-কলোনাইজ়েশন) নাম দিয়েছেন। নামটি যথাযথ। কেবল গণতন্ত্র নয়, ভারতের যে যুক্তরাষ্ট্রীয়তার মধ্যে তার সবচেয়ে বড় ঐক্যসূত্র, সেটিকে এ ভাবেই বিনষ্ট করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার আস্ফালন চলছে। ভারতীয় আইনবিধিও অতি সত্বর সেই সংখ্যাগরিষ্ঠের মনোমত সঙ্কীর্ণতায় পর্যবসিত হবে।